অপরিচিতা মহিলার সামনে বিবাহঘটিত আলোচনায় বিব্রত গুড়বেড়িয়া এবার দ্রুত পদক্ষেপে প্রস্থান করলে; বোসদা সানন্দে বললেন, ছাদের অধিবাসীদের আজ স্মরণীয় দিন। হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর, হবে জয়! তরুণ গুড়বেরিয়ার প্রাচীন স্বপ্ন সম্ভব হয়েছে।
সুজাতা মিত্র বললেন, আহা বেচারা।
বোসদা বললেন, ম্যানেজারকে বলে ওর ছুটি করিয়ে দিও। লোক কম আছে।সামনে আবার মিসেস পাকড়াশীর ব্যাংকোয়েট। কিন্তু তুমি বলো, দরকার হয় ছাদে আমরা দিন দশেক নিজেরাই সব করে নেব-বেয়ারা লাগবে না।
সুজাতা মিত্র বললেন, আপনারা দেখছি গুড়বেড়িয়ার গুণগ্রাহী।
বোসদা হেসে বললেন, অল দি ওয়ার্লড লাভ দি লাভার। গুড়বেড়িয়া বলেছিল—ওই মেয়ে ছাড়া বিয়ে করবে না।
বোসদা উৎসাহে এবার গুড়বেড়িয়াকে চিৎকার করে ডাকলেন। গুড়বেড়িয়া লিফটের কাছে একটা টুলে বসে ছিল। সায়েব ডাকতেই একটু চিন্তিত হয়ে আবার এসে সেলাম করল। বোসদা বললেন, তুমি বিয়ের বাজার করতে আরম্ভ করো। ছুটি পাবেই।
কৃতজ্ঞ গুড়বেড়িয়া আবার নমস্কার করল। তোমার বিশেষ কিছু ইচ্ছে করলে, জানাতে লজ্জা কোরো না। বোসদার এই আশ্বাসবাণীতে সাহস পেয়ে গুড়বেড়িয়া তার বহুদিনের একটি গোপন ইচ্ছা প্রকাশ করল। বিবাহ উপলক্ষে রঙিন রাঙতায় মোড়া একটা শাজাহান কেক সে নিয়ে যেতে চায়। প্রয়োজন হলে এক টাকা পর্যন্ত খরচ করতেও রাজি আছে।
বোসদা বললেন, জরুর। জুনোকে বলে তিন পাউন্ডের স্পেশাল ওয়েডিং কেক করিয়ে দেব। তাতে তোমার নাম লেখা থাকবে।
সৌভাগ্যসূর্যের এমন অভাবনীয় উদয়ে বিস্মিত গুড়বেড়িয়া বাকশক্তিরহিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বোসদা বললেন, বিয়ের পর বউমাকে কলকাতায় আনছ তো?
না, হুজুর। এখানে খরচ কত।
বোসদা বললেন, আমি তোমার ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। মমতাজে ডিউটি পড়লে রোজ বেশ কিছু টিপস পাবে।
গুড়বেড়িয়া চলে গেল। সুজাতা মিত্র বললে, এই একটি জিনিস-Tips!
বোসদা বললেন, আগে তাড়াতাড়ি সার্ভিসের জন্যে লোকে পয়সা দিত-To insure promptitude। আর এখন ইজ্জত রাখার জন্যে-To insure prestige। আর To insure peace, বেয়ারাদের মধ্যে টিপসের ভাগাভাগি খেয়োখেয়ি এড়াবার জন্যে, অনেক হোটেলে শতকরা দশ বা পনেরো ভাগ সার্ভিস চার্জ বসিয়ে বকশিস বন্ধ করে দিচ্ছে। আমাদের এখানেও মার্কোর ওই ব্যবস্থা চালু করার ইচ্ছে। মন মেজাজ ভালো থাকলে এতদিনে করেও দিতেন। জিমিটাকে দিয়ে কিছুই হবে না—একটা হতভাগা।
সুজাতা মিত্র আশ্চর্য হয়েই বোসদার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তারাভরা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে আমার মন এক বিচিত্র অনুভূতিতে ভরে উঠল। কবে, কোথায়, কতদিন আগে আমরা জন্মগ্রহণ করেছিলাম; আর সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে আজ এই মুহূর্তে আমরা তিনজন শাজাহানের ছাদে এসে জড়ো হয়েছি।
সত্যসুন্দর বোসের জীবন-নদী আপন বেগেই এতদিন ছুটে চলেছিল। কোথাকার এক পরিচয়হীন মেয়ে অকস্মাৎ বহুজনের অরণ্য থেকে বেরিয়ে এসে একটা প্রশ্ন করেই সমস্যাকে জটিল করে তুলল—আপন মনে নেচে কোথায় চলেছ তুমি?
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর যে অসংখ্য মানুষের দল শাজাহানের পান্থশালায় আতিথ্য গ্রহণ করেছে। তারা কেউ তো সাহেবগঞ্জের সত্যসুন্দর বোসকে সে প্রশ্ন করেনি।
সরলা বালিকার গভীর প্রশ্নে মুহূর্তের জন্য বিব্রত নদী উত্তর দিয়েছিল,–কেন? যৌবনের সেই উষালগ্নে কলেজকে প্রণাম করে যেদিন স্বেচ্ছায় এই অন্তত-যৌবনা পান্থশালায় আশ্রয় নিয়েছিলাম সেদিন থেকেই তো ছুটে চলেছি। আপন ছন্দে মত্ত হয়ে, জীবনের নদী আপন মনেই এগিয়ে চলেছে।
কিন্তু কোথায়?
তা তো জানি না। সত্যসুন্দরদার মা, তিনি তো কবে আর একটা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে সাহেবগঞ্জের হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সত্যসুন্দর বোস তখন ক্লাশ ফাইভে পড়েন। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো সে প্রশ্ন করতেন। বাবা? তিনি ব্যক্তিত্বের কঠিন আবরণের আড়ালে থেকে, মাসে মাসে মনি-অর্ডারে হোস্টেলের ঠিকানায় টাকা পাঠিয়েই কর্তব্য শেষ করেছেন।
সত্যসুন্দরদা যা আমাকেও কোনোদিন বলেননি, আজ তা প্রকাশ করলেন। জানেন, আমার এক সৎ মা আছেন।
তিনি বুঝি এই কোমল স্বভাবের রোমান্টিক ছেলেটির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কিছুই চিন্তা করেননি? সুজাতা মিত্র প্রশ্ন করলেন।
কোটি কোটি আলোক বৎসর দুরের তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে সাহেবগঞ্জের সত্যসুন্দর বোস অনেকক্ষণ বোবার মতো তাকিয়ে রইলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, সে ভদ্রমহিলাকে দোষ দিয়ে কী লাভ? আমার থেকে তার বয়স হয়তো মাত্র কয়েক বছর বেশি। নিজের অনিশ্চিত অন্ধকার ভবিষ্যতের চিন্তা করতে করতেই তিনি নিশ্চয় ব্যতিব্যস্ত।
আজ পৃথিবীর কোনো দেশের কোনো শহরেই সত্যসুন্দরদার আপন জন নেই। হোম অ্যাড্রেস বলেও কিছু নেই তার। কর্তব্যের মধ্যে বিধবা সৎ মাকে মাঝে মাঝে মনি-অর্ডারে টাকা পাঠান।
স্তব্ধতার গুমোট কাটিয়ে শাজাহানের বিষণ্ণ আকাশে হঠাৎ ভায়োলিনের করুণ সুর বেজে উঠল। আমাদের এই আনন্দের হাটে অমন ভাবে কে যেন প্রিয়জনবিরহে রাতের গভীরে সবার অলক্ষ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। প্রভাতচন্দ্র গোমেজ নিজের ঘরে বসে বসে সপ্তদশ, অষ্টাদশ কিংবা ঊনবিংশ শতাব্দীর কোনো হতভাগ্য সুরগুরুর চরণে সুরের প্রণাম নিবেদন করছেন। হান্ডেল, বাক, বীঠোফেন, সুবার্ট, সুম্যান, ভাগনার, ব্রাহাম, মোৎসার্ট, শোঁপা, মেন্ডেলসনের সুরের জগতে যেন কেবলই বেদনা। কোন সুদূর দেশের বহু শতাব্দীর আগের বেদনাধ্বনি এতদিন ইথারবাহিত হয়ে এই রাত্রে শাজাহানের শীর্ষদেশে পৌঁছেছে।