কিন্তু ওই অঙ্ক জিনিসটা। পৃথিবীতে ভালো কিছু হতে গেলেই, প্রথমে আপনাকে প্রশ্ন করবে—অঙ্ক জানো? ইঞ্জিনিয়ার হতে চাও, বলবে অঙ্ক জানো? রোগের চিকিৎসার জন্যে ডাক্তার হতে চাও, তখনও অঙ্ক চাইবে। যা দিনকাল পড়েছে, তাতে ছবি আঁকা শেখার জন্যেও আর্ট স্কুলের প্রিন্সিপাল অঙ্কের নম্বর দেখতে চাইবে।
সুজাতা মিত্র বললেন,বাংলার প্রথম মহিলা পাইলট হওয়ার দুর্লভ সৌভাগ্য একটুর জন্যে হাতছাড়া হয়ে গেল। কিন্তু নাকের বদলে নরুন পেলাম। আমি বলেছিলাম, আমি কিছুতেই ছাড়বনা। আকাশে আমাকে উড়তে হবে।ককপিটে বসে বন্ধু তারাদের নিশানা করে মহাশূন্যে আমি সাঁতার কাটব। মা, বাবা, তোমাদের কিন্তু টিকিট লাগবে না। তোমরা নিজেদের সিটে বসে থাকবে, মাঝে মাঝে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করবে। মা বলেছিলেন, এতই যখন তোর ওড়ার নেশা, তখন কোনো পাইলটের সঙ্গে তোর বিয়ে দেবখন।
অন্যায় কিছু বলেননি তিনি, বোসদা বললেন।আপনার ঘর ঝাঁট দেবার জন্যে একটা বিনা মাইনের শিক্ষিত পাইলট চাকর পেতেন!
সুজাতা মিত্র রাগ করলেন।এমন ঝগড়াটে স্বভাব নিয়ে কী করে যে আপনি হোটেলে রিসেপশনিস্টের কাজ করেন।
জিজ্ঞাসা করুন এই শ্রীমানকে। ভূ-ভারতে সত্যসুন্দর বোসের মতো আর একটি রিসেপশনিস্টের জন্ম হয়েছে কিনা? বিলেতে জন্মালে এতদিনেক্লারিজের ম্যানেজার হতাম। আমেরিকায় জন্মালে ওয়াল্ডর্ফ এস্টোরিয়া হোটেলের বর্তমান ম্যানেজার বেচারার কী যে হত! কী হে শ্রীমান, আমার সাপোর্টে কিছু বলো।
আমি মনস্থির করতে পারছিলাম না। কিন্তু তার আগেই সুজাতা মিত্র অবলীলাক্রমে আমাকেও আক্রমণ করলেন—ভালো লোককে দলে টানছেন—শুড়ির সাক্ষী মাতাল!
এবার নিজেই হাসতে আরম্ভ করলেন সুজাতা।আমাকে বললেন, তুমি কিছু মনে করো না, ভাই। তোমাকে কিছু মিন করিনি।
আমি ইতিমধ্যে স্থির করে ফেলেছি, বোসদারই দোষ। বললাম, আপনারই দোষ। কথার মধ্যে আপনি কথা বলেন কেন?
বোসদা হতাশ হয়ে যেন মাথায় হাত দিয়ে বসলেন।দাউ টু টাস! একজন এয়ার হোস্টেসের সামান্য মিষ্টিকথায় ভিজে গিয়ে তুমি এতদিনের বিশ্বস্ত বন্ধুকে ডোবালে? অথচ তুমি বুঝলে না, হাওয়াই হোস্টেসরা আমাদেরই মতো জোর করে ট্যাবলেট খেয়ে হাসেন। হাসাই ওঁদের চাকরি অঙ্গ। যেমন পেটের যন্ত্রণায় পাগল হয়ে গেলেও হোটেলের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আমাদের দন্তকৌমুদী বিকশিত করতে হয়।
আমি বললাম, সুতরাং রিসেপশনিস্ট এবং এয়ার হোস্টেসেকাটাকাটি হয়ে গেল। যাকে বলে কিনা কাঠে কাঠে।
বোসদা মৃদু হাস্যে বললেন, কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছ, আমি যদি শুড়ি হই, তাহলে তুমি মাতাল। হোটেলে চাকরি করি, মদের লাইসেন্স আছে, সুতরাং শুড়ি তো বটেই। অথচ বেচারা তোমার স্টেনলেস স্টিলের মতো শুভ্র চরিত্রে এই মুখরা মহিলা অযথা কলঙ্ক লেপন করলেন।
আমরা সবাই এবার এক সঙ্গে শাজাহানের ছাদের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে হো হো হেসে উঠলাম। সুজাতার মিত্র বললেন,ক্যাপটেনের প্রতাপ কী সে আমরা জানি; আপনারা যেমন ম্যানেজার নামক বস্তুটিকে বোঝেন। কিন্তু তাতে আর হল কী-হতে চেয়েছিলাম ডাক্তার, হলাম নার্স-পাইলটের বদলে হাওয়াই হোস্টেস।
বোসদা গম্ভীর হয়ে বললেন, আমার এক মামা পুলিস সুপারিন্টেন্ডেন্ট হতে চেয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত অফিস সুপারিন্টেন্ডেন্ট হয়েছেন।
সুজাতা মিত্র বললেন, ব্যঙ্গ করছেন, কিন্তু কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে…।
আমরা আবার অট্টহাস্যে ভেঙে পড়তে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই কে যেন ছাদের আলোগুলো হঠাৎ জ্বালিয়ে দিল। মনে হল গুড়বেড়িয়া যেন হন্তদন্ত হয়ে আমাদের দিকেই ছুটে আসছে।
কে, গুড়বেড়িয়া? অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বোসদা বললেন।
হ্যাঁ হুজুর, আমাদের দিকে মাথা নত করে গুড়বেড়িয়া বললে। জানলাম মার্কোপোলো ডিনারের পরে আমাকে দেখা করতে বলেছেন।
আমি বললাম, ঠিক আছে।
গুড়বেড়িয়ায় এবার চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে তখনও মূর্তিমান গদ্যের মতো আমাদের কাব্যজগতে দাঁড়িয়ে রইল। মুখ তুলে গুড়বেড়িয়াকে বললাম, কী বাপার? গুড়বেড়িয়া আমতা আমতা করতে লাগল। সুজাতা মিত্র বোধহয় ব্যাপারটা বুঝলেন। বললেন, আচ্ছা, আমি তাহলে উঠি, আপনারা কথা বলুন।
আমি বাধা দিলাম আর বোসদা বললেন, শ্রীমান গুড়বেড়িয়া, পৃথিবীর গোপনীয়তম খবরও তুমি এই ত্রিমূর্তির কাছে দিতে পারো। দিদিমণি হাওয়াই জাহাজে আকাশের উপর উড়ে গিয়ে কত খবর নিয়ে আসেন। সে সব গোপন থাকে।
গুড়বেড়িয়া এবার সাহস পেয়ে জানালে, আমি যখন মার্কো সায়েবের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, তখন ইচ্ছে করলেই তার বিশেষ উপকার করতে পারি। এবং সেই বিশেষ উপকারের জন্যে শুধু সে নয়, আরও একজন-শাজাহানের হেড বেয়ারা পরবাসীয়া—আমাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। নীরব সাধনা এবং সুগভীর ধৈর্যে অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। পরবাসীয়ার মন গলেছে—তার কনিষ্ঠা কন্যার পাণিগ্রহণের জন্য তিনি শ্রীমান গুড়বেড়িয়াকে যোগ্য বলে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু ভাবী জামাতার ছুটি ও উন্নতির তদ্বিরের জন্য তার পক্ষে উচ্চতম কর্তৃপক্ষের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া পরবাসীয়া তার সুন্দরী, গৃহকর্মনিপুণা, গুণবতী কন্যার পাণিপ্রার্থী যুবকটির কৌশল এবং বুদ্ধিপ্রয়োগের ক্ষমতা পরীক্ষা করতে চান। বিবাহবিলাসী যুবক গুড়বেড়িয়া দুরুদুরু বক্ষে সুদুর উড়িষ্যার কোনো পল্লি থেকে সেই আদি অকৃত্রিম টেলিগ্রাম—মাদার সিরিয়াস, কাম হোম—পাঠাবার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু ভাবী শ্বশুর সম্মতি দিতে পারেননি। কারণ বিবাহহাৎসবে তারও উপস্থিতি প্রয়োজন এবং টেলিগ্রাম-পদ্ধতিতে ছুটি তিনি নিজেই নেবেন। একই উপায়ে শ্বশুর-জামাই-এ ছুটি নেওয়া এই শত্ৰুপরিবৃত পুরীতে বিশেষ বিপজ্জনক।