আমি বললাম, নিশ্চয়ই। সেখান থেকেই তো আমাদের কাস্টমাররা আসে, আবার সেখানেই তারা ফিরে যায়।
ভদ্রমহিলা তখন কী বললেন জানো? এমনভাবে জীবনটা নষ্ট করছেন কেন? এই হোটেলের ভূতটা আপনাদের ঘাড়ে পুরোপুরি চেপে বসেছে। আপনাদের পাল্লায় পড়ে ওই ছেলেটিরও ইহকাল পরকাল ঝরঝরে হয়ে যাচ্ছে।
আপনি উত্তর দেননি? আমি প্রশ্ন করেছিলাম।
আপনি বলেছিলেন, ভেবেছিলাম উত্তর দেব। কিন্তু পারলাম না। ভদ্রমহিলার সাহস যে এত বেড়ে যাবে ভাবিনি।
স্যাটা বোস উত্তর দিতে পারেননি শুনে সত্যই আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এমন যে হতে পারে তা যেন আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। অনেকদিন পরে সেদিন ভিক্টর হুগো পড়তে আমার বিস্ময়ের উত্তর পেয়েছিলাম : The first symptom of love in a young man is timidity;in a girl it is boldness. The two sexes have a tendency to approach and each assumes the qualities of the others.
মনে আছে সত্যসুন্দরদা বলেছিলেন, আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু আকাশের এই তারার ভার দিকে তাকিয়ে এখন সত্যিই মনে হচ্ছে, শাজাহানের বন্দিশালায় স্বেচ্ছা-নির্বাসনে আমরা পৃথিবীর অনেক আনন্দ এবং আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
ঘড়ির দিকে তাকালেন বোসদা।বললেন, বলা যায় না, সুজাতা মিত্র এখানে এসে হাজির হতে পারেন।
ভালোই তো, তাহলে একহাত ঝগড়া করে নেওয়া যায়, আমি বললাম।
একটা সিগারেট ধরিয়ে বোসদা বললেন, আজ আবার নাইট ডিউটি।কিন্তু কাজে যেতে ইচ্ছা করছে না।
বললাম, আমি থাকতে যাবার দরকার তো নেই।
বোসদা বললেন, গত জন্মে নিশ্চয় বহুদিন মা-বাপকে অনেক রাত পর্যন্ত জাগিয়ে রেখেছিলাম, তাই এ-জন্মে ফলভোগ করছি। আবার তোমাকে জাগিয়ে, পরের জন্মের হিসেব খারাপ করে দিই আর কী!
বললাম, পরোপকার তো হবে। এখন আপনাকে সার্ভিস দিলে সামনের জন্মে এই শ্রীমান সারারাত ভোস ভোস করে নাক ডেকে ঘুমোতে পারবে।
বোসদা আমার কথা কানে তুললেন না। আস্তে আস্তে বললেন, এতদিন নিজের মনে হোটেলের মধ্যে ড়ুবে ছিলাম। আমার যে বাইরের একটা অস্তিত্ব আছে, একদিন আমিও যে বাইরে থেকে এখানে এসেছিলাম, তা ভুলেই গিয়েছিলাম।
আসতে পারি? ছাদের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে সুজাতা মিত্র প্রশ্ন করলেন। নিশ্চয়ই। এই বাড়ির ছাদ কিছু আমাদের রিজার্ভ সম্পত্তি নয়। বোসদা বললেন।
সিল্কের শাড়িটাকে দুরন্ত হাওয়ার হাত থেকে সামলাতে সামলাতে সুজাতা মিত্র আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি উঠে পড়ে নিজের জায়গা ছেড়ে দিলাম। ঘরের ভিতর চলে যাব ভাবছিলাম।
কিন্তু বোসদা বললেন, আমার ঘর থেকে মোড়াটা নিয়ে এসে বসো, আচ্ছা দেওয়া যাক।
সুজাতা মিত্র এবার দংশন করলেন : আপনার সঙ্গে আড্ডা! এখনি লাঞ্চ, ডিনার, ব্রেকফাস্ট আমদানি করে বসবেন।
কথার মধ্যে যা-ই আনি, আপাতত কি অসময়ে একটু চা আনাতে পারি? বোসদা এবার জিজ্ঞাসা করলেন।
সুজাতা মিত্র ছাড়লেন না। বললেন, হোটেলের স্টাফগুলো অনেক সুবিধে ভোগ করে। দেখলে হিংসে হয়। গেস্টরা খেতে পাক না পাক, এরা সব সময় সব জিনিস পায়! পেটুক লোকেরা সেই জন্যেই তো হোটেলের কর্মচারীদের হিংসে করে।
বোসদা হেসে বললেন, সব ছোট ছেলেই তো ওই জন্যে ভাবে বড় হয়ে সে চকোলেটের কারখানার কাজ করবে।
সুজাতা মিত্র এবার গম্ভীর হয়ে উঠলেন।যেমন আমি চেয়েছিলাম হাওয়াই জাহাজের চাকরি!
আমি ও বোসদা সুজাতা মিত্রের ছেলেমানুষীভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সুজাতা মিত্র বললেন, আমি তখন ইস্কুলে পড়ি। বোম্বাইতে থাকতাম। ট্রেনের রিজার্ভেশন না পেয়ে বাবা বোম্বাই থেকে প্লেনে কলকাতা আসবার ঠিক করলেন। আর সেই হল আমার কাল।
আমি বললাম, কেন?
শাড়ির আঁচলটা হাওয়ার অশোভন কৌতূহল থেকে সামলিয়ে সুজাতা মিত্র বললেন,প্লেনেউঠেই আমার জীবনের সব ধারা যেন অন্য খাতে বইতে আরম্ভ করল। সারাক্ষণ আমি পাইলটের ককপিটের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ক্যাপটেন লোকটি ভালো ছিলেন, মজা পেয়ে আমাকে আদর করে, ধৈর্য ধরে সব দেখালেন, গল্প করলেন।
বোসদা এবার ফোড়ন দিলেন,সেটা ক্যাপটেন তেমন উদার কিছু করেননি। এমন আকর্ষণীয় মহিলা পেলে, আমিও প্লেন চালানো অবহেলা করে, তার সঙ্গসুখ উপভোগ করতাম।
সুজাতা মিত্র রেগে গেলেন।অমন করলে গল্প বলব না। শুনছেন একটা ইস্কুলে পড়া বারো বছরের মেয়ে প্লেনে চড়েছে।
এর উত্তর বিদ্যাপতির থেকে কোটেশনে দিতে হয়। কিন্তু ভদ্রলোক সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী মহিলাদের সম্বন্ধে এত অপ্রীতিকর উক্তি করেছেন যে, চেপে যাওয়াই ভালো।
সুজাতা মিত্র বললেন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ হলেও হয়তো অত আনন্দ হত না। আমার অটোগ্রাফের খাতায় যখন ক্যাপটেন সই করে দিলেন, তখন মনে হল হাতের মুঠোর মধ্যে স্বর্গ পেয়েছি।
আমি বললাম, বাবা, আমি পাইলট হব।আমার কথার ওপর কথা বলবার মতো সাহস আমার বাবার ছিল না। অফিসে তার দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল, কিন্তু আমার কথার অবাধ্য হতেন না তিনি। বলতেন, তুমি আমার ছেলে এবং মেয়ে দুই-ই।
সুজাতা মিত্র এতদিনে আবার যেন অতীতের নীল দিঘিতে অবগাহনের সুযোগ পেয়েছেন। মধুর স্মৃতির অতলে ড়ুব দিয়ে সুজাতা মিত্র বললেন, শেষ পর্যন্ত অঙ্ক জিনিসটাই আমার কাল হল। মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও বাবা বলেছিলেন, তুমি মন দিয়ে লেখাপড়া করো, তারপর যে যাই বলুক, তোমাকে পাইলট করব।