উইলিয়ম বলেছিল,আমার কিছুই তাতে এসে যায় না, রোজি, আমরা সবাই তো এতদিন ক্রীতদাস হয়ে ছিলাম, আমাদের ভারতবর্ষের এই কোটি কোটি মানুষ এতবছর ধরে অন্য এক জাতের কাছে কেনা হয়ে ছিল।
রোজি বলেছিল, তুমি আমাকে আর প্রলোভন দেখিও না। তুমি দয়া করে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করো। না হলে, এখনই আমার ইচ্ছে করবে তোমাকে বিয়ে করতে, আমি আর দেরি সহ্য করতে পারব না।
উইলিয়ম বলেছিল, রোজি, আর দেরি করা চলে না। আরও পাঁচ বছর পরে আমার কী থাকবে? আর তোমারও? আখের দুখানা ছোবড়ার মধ্যে বিয়ে দিয়ে কী লাভ হবে?
কাউন্টারে খাতা লিখতে লিখতে উইলিয়ম আমাকে বললে, আমাদের বিয়ে হবে না। রোজিকে বলেছিলাম, তুমি বিয়ের পরও যেমন চাকরি করছ, করো। রোজি বললে, মোটেই না। বিয়ের পর শয়তান জিমিটা আমাকে একদিনও এখানে চাকরি করতে দেবে না। আমার চাকরিটা খেয়ে ছাড়বে। ওকে তো তোমরা চেনেন না।
আমি একটুকরো পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে উইলিয়মকে দেখতে লাগলাম।
উইলিয়ম এবার গভীর দুঃখের সঙ্গে বললে, হয়তো আপনি আমাকে স্বার্থপর বলবেন। কিন্তু আমি আর ধারে ব্যবসা করতে চাই না। এখন আমার সাঁইত্রিশ বছর বয়স, ওর সঙ্গে পাঁচ যোগ করলে বিয়াল্লিশ। অসম্ভব। জীবনে অনেক ঠকেছি। আমি আর বোকার মতো অপেক্ষা করে ঠকতে চাই না।
১৬. আজ যদি কেউ আমাকে প্রশ্ন করে
আজ যদি কেউ আমাকে প্রশ্ন করে, শাজাহানের কোন ঐশ্বর্যে আমি সবচেয়ে লাভবান হয়েছি, তা হলে কোনো দ্বিধা না করেই বলব-কর্মীদের ভালোবাসা। একই কর্মক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা নিজেরই অজ্ঞাতে কেমন করে সৃষ্টি হয় বলা শক্ত। কিন্তু হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করা যায়, অনেকগুলো প্রাণ কখন একই সূত্রে গাঁধা হয়ে গিয়েছে।
সেই কারণেই বোধহয় আমি ভুলে গিয়েছিলাম, প্রথম জীবনে রোজি আমার বহু যন্ত্রণার কারণ হয়েছিল। ভুলে গিয়েছি, উইলিয়ম ঘোষ, গুড়বেড়িয়া, ন্যাটাহারিবাবুর সঙ্গে সামান্য কিছুদিন আগেও আমার পরিচয় ছিল না। অথচ আজ তাদের সম্বন্ধে আমি কত জানি।
ন্যাটাহারিবাবু বলেছিলেন, এ শর্মা হাতের গোড়ায় থাকতে কেন অযথা নিজের বুদ্ধির পাম্পটাকে খাটিয়ে মারেন? অধমকে একবার তু করে ডাক দেবেন! ব্যাপারটা কী জানেন, এটা যেবের মতন। মনে করুন আপনার কোনো বন্ধুকে পনেরো বছর ধরে জানেন; সে-ই তার এক জানাশুনোনা মেয়ের সঙ্গে আপনার বে-র সম্বন্ধ করলে। বে-র কদিন পরে দেখা যাবে, আপনার ওয়াইফ আপনার সম্বন্ধে বন্ধুর থেকে অনেক বেশি জেনে গিয়েছে। চাকরিটাও তো ‘বে’র মতন, আসলে বিবাহের চেয়ে বড় বলতে পারেন।
নাট্যহারিবাবুকে আমি ঘাটাইনি। কিন্তু তিনি ছাড়লেন না। আমাকে কাছে ডেকে ফিস্ ফিস করে বললেন, ব্যাপার কী মশাই? স্যাটা বোস দেখলাম ম্যানেজারের কাছে কিছুক্ষণের জন্যে ছুটি চাইছে। যে লোকটা এই বারো বছরের মধ্যে কখনও বাইরে যায় না, তার আজ হল কী? গতিক সুবিধে মনে হচ্ছে না। আমার ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় অভ্যেস নেই, সোজা বলে দিলাম।
ন্যাটাহারিবাবুকে বাধা দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তিনি তার আগেই বললেন, একটা জিনিস জেনে রাখবেন—ধোঁয়া, টাকা আর প্রেম কিছুতেই চেপে রাখা যায় না। ঠিক ফুটে বেরোবেই।
আমাকে প্রতিবাদের কোনো সুযোগ না দিয়ে তিনি হোটেলের কাজে অন্য ঘরে চলে গেলেন। আর আমার মনে হল, সত্যসুন্দরদা সত্যিই যেন আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছেন।
সত্যসুন্দরদা, এতদিন পরে, আজ আর স্বীকার করতে লজ্জা নেই, সেদিন সত্যিই সুজাতাদির উপর আমার হিংসে হয়েছিল। শাজাহানের প্রাচীন পন্থশালার এক অপরিচিত যুবককে আপনি উজাড় করে ভালোবাসা দিয়েছেন, তবুও যেন তার মন ভরেনি। সে আরও চেয়েছিল।
শাজাহানের সেই সন্ধ্যার কথা মনে আছে আপনার? ছাদের উপর একটা ইজিচেয়ার নিয়ে আপনি বসেছিলেন; একে একে আকাশে তারার দ্বীপগুলো জ্বলে উঠছিল। সেদিন আপনাকে যেন অন্যভাবে দেখেছিলাম। শাজাহানের কাউন্টারে যে একদিন আমাকে প্রথম অভ্যর্থনা করেছিল, সুখে দুঃখে যার আশ্রয়ে এতদিন আমি লালিত-পালিত হয়েছি, এ যেন সেই স্যাটা বোস নয়।
সত্যসুন্দরদা, আপনি যখন আমাকে অমনভাবে পাশে বসতে বলেছিলেন, তখন আরও ভয় পেয়েছিলাম। আপনি যেন কেমন শান্ত হয়ে পড়েছিলেন। জলভারে নম্র মেঘের মতো আপনার গতি যেন শ্লথ হয়ে পড়েছিল। আপনার মনের গাড়ি তখন যেন ইঞ্জিন বন্ধ করে কোনো ঢালু পথ দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছিল। আমি কোনো কথা না বলে, আপনার পাশে একটা মোড়ায় অনেকক্ষণ বলেছিলাম। আপনি হয়তো ভেবেছিলেন, আমি কিছুই জানিনা; অথচ আমাকে সত্যিই আপনি ভালোবাসতেন, আমাকে না জানিয়ে কিছুই করতে ইচ্ছে করছিল আপনার। |||||
||||| আপনি বলেছিলেন, তোমার সম্বন্ধে মিস্ মিত্রের খুব ভালো ধারণা। মিস্ মিত্র বলছিলেন, তোমার মুখের মধ্যে ছোটছেলের সারল্যের ছবি আছে।
আমি লজ্জা পেয়ে একটু হাসলাম। আপনি বললেন, ভদ্রমহিলাও খুব সরল। হোটেলে চাকরি করতে এসে এয়ার হোস্টেস তো কম দেখলাম না। কিন্তু এমন লাজুক স্বভাবের মেয়ে কেমন করে যে মধ্যগগনে যাত্রীদের মনোরঞ্জন করেন, জানি না।
আমি বলেছিলাম,এক একজনের স্বভাবেই এই স্নিগ্ধ সরলতা থাকে। ইচ্ছে করলেও কাটিয়ে ওঠা যায় না।
আপনার মনে বোধহয় কথাটা লেগেছিল। সুজাতাদিকে আপনি নিজের অজ্ঞাতেই কখন যেন শ্রদ্ধা করতে আরম্ভ করেছিলেন। প্রকৃত প্রেমের ভিত্তিভূমিই এই শ্রদ্ধা। আপনি বলেছিলেন, আজ বেশ বোকা বনে গেলাম। ভদ্রমহিলা যে অমনভবে প্রশ্ন করবেন, বুঝিনি। আমার উপর রেগে গিয়েই বললেন, এই হোটেলের বাইরেও যে একটা জীবন আছে, তা জানেন কী?