লিজার চোখ দুটো বিদ্যুতের অভাবে ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে আসছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সুশান আবার ফিরে এসেছে নাকি? মেজর স্যানন তার পিছনে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে তো। আমি তখনই বলেছিলাম, ওই রকম হবে।
অনেকদিন আগে আগ্নেগিরির প্রকোপে আটলান্টিক মহাসাগরে হারিয়ে যাওয়া এক দ্বীপ হঠাৎ যেন আমারই চোখের সামনে আবার ভেসে উঠছে। যা এতদিন অসাধ্য বলে পরিগণিত ছিল, আমিই যেন আকস্মিক তাকে খুঁজে বার করবার বিরল সৌভাগ্য লাভ করেছি।
লিজা বললে, টাকা দিলে তখন সবই হত। আমেরিকান সোলজাররা টাকা দিয়ে সব করাতে পারত। না হলে পুলিসের খাতায় যার অমন খারাপ নাম, তাকে সতীসাধ্বী সাজিয়ে স্যানন কেমন করে ইলিনয়তে নিয়ে গেল?ইচ্ছে ছিল বিয়ের কাজটা এখান থেকে সেরে যায়, কিন্তু সাহস করলে না। তখনও কোর্টে ডাইভোর্স মামলা ঝুলছে। আইনের চোখ তার অন্য স্বামী রয়েছে। ইলিনয়তে সে খবর কে আর রাখছে? আর এতদিনে নামধাম পালটিয়ে সুশান মনরো যে কী হয়ে গেছে কে জানে। কিন্তু আমি তখনই বলেছিলাম, সব ভালো যার শেষ ভালো। এর শেষ ভালো হবে না।
একবার লোভ হয়েছিল, লিজাকে সব খুলে বলি। প্রশ্ন করি, মার্কোপোলো নামে কোনো বিদেশির সঙ্গে শাজাহানের ডাইনিং রুমে তার সান্ধ্যবিহারের কথা মনে আছে কিনা। কিন্তু অনেক কষ্টে সে লোভ সংবরণ করে, সেদিন লিজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এসেছি।
আরও কিছুক্ষণ বসবার ইচ্ছে ছিল। ছাতাওয়ালা লেনে আমার জীবনের এক ফেলে-আসা অধ্যায়কে অনেকদিন পরে খুঁজে পেয়ে আবার খুঁটিয়ে দেখবার লোভ হচ্ছিল। কিন্তু বাইরে বায়রন আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। একলা রাস্তায় এতক্ষণ দাঁড়িয়ে তিনি নিশ্চয়ই অধৈর্য হয়ে পড়েছেন।
ইউরেকা! ইউরেকা! বায়রন সায়েব আনন্দে দিশেহারা হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ইট ওয়াজ গড় উইল। না হলে এমন হবে কেন?
হলে তুমিও বা শাজাহানে এসে ভর্তি হবে কেন? এবং তারও আগে তুমি ঝুড়ি বেচাকেনার জন্যে ছাতাওয়ালা গলিতে আসবে কেন?
একটা ট্যাক্সির দিকে বায়রন সায়েব এবার ছুটে গেলেন। বললেন, আর এক মুহূর্ত দেরি নয়। এখনই শাজাহান হোটেল।
শাজাহান হোটেলে নেমে প্রায় ছুটতে ছুটতে বায়রন উপরে উঠে গিয়েছিলেন। এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে মার্কোকে সঙ্গে করে আবার বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
কাউন্টারে উইলিয়ম ঘোষ তখন ডিউটি দিচ্ছিল। সত্যসুন্দরদারও এই সময়ে থাকবার কথা ছিল, কিন্তু তাঁকে দেখলাম না। বেচারা উইলিয়ম! ওর মনটা যে বেশ খারাপ তা ওর মুখ দেখেই বুঝলাম। কলের মতো সে কাজ করে যাচ্ছে। কাছে এসে বললাম, কাউন্টারে একা হিমশিম খাচ্ছেন, সাহায্য করব?
গলার টাইটা একটু টাইট করে নিয়ে উইলিয়াম বিমর্ষভাবে বললে, এবার থেকে কারুর সাহায্য না নিয়েই পৃথিবীতে চলবার চেষ্টা করব।
রসিকতা করবার জন্যে বললাম, শ্রীমতী রোজিরও সাহায্য নেবেননা?শঙ্খ এবং উলুধ্বনির মধ্যে শ্রীমতী কবে মদন দত্ত লেন বাসিনী হচ্ছেন?
উইলিয়ম এবার যেন আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। আপনার কানে সব খবরই আসবে, সুতরাং চাপা দিয়ে লাভ নেই। এ জানলে রোজির সঙ্গে আমি ঘোরাঘুরি করতাম না। শুধু শুধুই এতদিন আপনাকে কষ্ট দিয়েছি, আপনাকে ডবল ডিউটিতে বসিয়ে রোজিকে সঙ্গে করে অন্য হোটেলে খেতে গিয়েছি।
তাতে মহাভারতের কী অশুদ্ধি হয়েছে?আমি উইলিয়মকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে প্রশ্ন করলাম।
কাজ থামিয়ে উইলিয়ম বললে, কৈশোর আর যৌবন পথে পথে কাটিয়ে, এই প্রৌঢ় জাহাজখানা শাজাহানের বন্দরে ভিড়িয়েছিলাম। আরকদিনই বা বাকি? রোজির সঙ্গে অন্তরঙ্গতার পর ভেবেছিলাম, শাজাহান আমাকে এ-লাইনে শিক্ষা দিয়েছে, আমার অন্ন দিচ্ছে এবং লাস্ট বাট দি লিস্ট আমার স্ত্রীকে দেবে। ওর সব ছেলেমানুষী, ওর সব দুর্বলতা সত্ত্বেও আমি সত্যিই রোজিকে ভালোবেসে ছিলাম। এখন সে কী বলে জানেন? বলে, তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে, অন্ততঃ আরও পাঁচ বছর। এর মধ্যে ওর অসুস্থ বাবা মা নিশ্চয়ই চোখ বুজবেন, ওর বোনগুলোরও একটা হিল্লে হয়ে যাবে। তার আগে বিয়ে করে সুখী হবার কথা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না।
রোজি! শাজাহান হোটেলের কৃষ্ণকলি টাইপিস্ট, রোজি। এতদিন ধরে আমি শুধু ঘৃণা এবং অবজ্ঞার চোখেই দেখে এসেছি। এই মুহূর্তে সে আমারই ঘরের অতি আপনজন হয়ে উঠছে।
উইলিয়ম বললে, একদিন রোজি আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। বাড়ি নয়, বস্তি। দেড়খানা ঘরে ওদের যা অবস্থা! সারক্ষণ তিনটে রোগী দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে রয়েছে, কাশছে, থুথু ফেলছে। যেন নরককুণ্ড। রোজির অসুস্থ বাবা-মা আমাকে দেখে বোধহয় ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তাদের ভয়, মেয়ে যেন কোথাও মন দিয়ে না বসে, তাহলে তাদের না খেতে পেয়ে মরতে হবে।
বস্তির অন্য লোকদেরও দেখেছিলাম। অনেকেরই কোঁকড়া চুল, একটু পুরু পুরু ঠোঁট। রোজি আমাকে সেদিনই বলেছিল, শাজাহানে যে রোজিকে দেখো, তার শিকড় রয়েছে এইখানে। রোজি আরও বলেছিল, তোমাকে আর একটা কথা জানানো উচিত। আমাকে হয়তো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ভাবছ, আমিও বাজারে তাই বলে বেড়াই। কিন্তু আমরা আসলে কিন্তলী। এই বস্তির প্রায় সবাই প্রাচীন কলকাতার আফ্রিকান ক্রীতদাসদের বংশধর।
উইলিয়ম ঘোষ বিস্ময়ে রোজির মুখের দিকে তাকিয়েছিল। রোজি বলেছিল, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম প্রহরে সুদূর আফ্রিকা থেকে তাদের পূর্বপুরুষদের কোমরে দড়ি বেঁধে কারা চাঁদপাল ঘাটে জাহাজ থেকে নামিয়েছিলেন, তারপর মুরগিহাটার ক্রীতদাসদের বাজারে পঁচিশ টাকা দামে তাদের বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। কলকাতার কর্তাব্যক্তিরা তখন সবাই হাট থেকে মনের মতন ক্রীতদাসী কিনতেন। তারও অনেক পরে একদিন আইন করে ক্রীতদাসদের মুক্তি দেওয়া হল। কিন্তু মুক্তি পেয়েও তারা আর কোথায় যাবে? এই কলকাতাতেই রয়ে গেল। তাদের আলাদা নাম ছিল না, প্রভুর নামে নাম। অনেকদিন আগে রামের ক্রীতদাসরা যা করেছিল, কলকাতার ক্রীতদাসরা তাই করল। ডিকসন সায়েবের ক্রীতদাস ডিকসন সায়েবের নাম নিলে। শেক্সপীয়র সায়েবেরা ক্রীতদাসও একদিন মিস্টার শেক্সপীয়র নাম নিয়ে বস্তিতে এসে উঠল। সেই থেকেই চলছে। এই একশ বছরেও সুদূর আফ্রিকার বিচিত্র মানুষের ধারা ভারত সমুদ্রের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হতে পারল না। দুঃখ, দারিদ্র্য, অনটন এবং সন্দেহের মধ্যে তারা আজও কিন্তলী হয়েই রইল।