শাজাহান হোটেল! তারা অবাক হয়ে গিয়েছিল। ওখানে নাকি সাড়ে আট টাকায় ওয়ান্ডারফুল ডিনার পাওয়া যায়? আমাদের খুব খেতে ইচ্ছে করে। টাকা থাকলে দল বেঁধে আমরা যেতাম। যুদ্ধের সময় খুব সুবিধে ছিল। যুদ্ধের পরে যারা এ-লাইনে এসেছে তারা কৌতূহলে সিনিয়ারদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।তখন সোলজারদের বললেই খুশি হয়ে হোটেলে নিয়ে যেত। আর এখন একটা সিগারেট চাইলেই ভাবে ঠকিয়ে নিচ্ছে। বিল সরকারের মনোবৃত্তি নিয়ে আজকাল কলকাতার লোকরা আনন্দ করতে আসে।
বললাম, আপনারা কেউ সুশান মনরোকে চিনতেন? পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় গান গাইতেন।
এমন নাম তো আমরা কেউ শুনিনি। পার্কস্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় যে গান গাইত সে কোন দুঃখে আমাদের এখানে আসবে?
আর একজন বললে, কেন? এলিজাবেথ? ও বুড়ি তো বলে, একদিন সে নাকি গান গাইত। এখন ভাগ্যদোষে এই ডাস্টবিনে এসে পড়েছে।
এলিজাবেথ কে? আমি বললাম।
কেন, মনে পড়ছে না? যে তোমার ঝুড়িগুলোর হিসেব রাখত। একদিন দুপুরে বৃষ্টিতে ভিজে এসে যার তোয়ালে নিয়ে তুমি গা মুছলে।
এবার মনে পড়েছে। এলিজাবেথ লিজা। কোথায় তিনি? আমি প্রশ্ন করলাম।
শুয়ে আছে। অসুখ করেছে, কে একজন বললে। দূর থেকে আমাকে একজন ঘরটা দেখিয়ে দিল। দরজাটা বাইরে থেকে ভেজানো ছিল। আমি দরজায় টোকা দিলাম। ভিতর থেকে মিহি গলার উত্তর এল, কাম ইন।
এলিজাবেথ আমাকে দেখেই চিনতে পারল। বিছানার উপর সে উঠে বসবার চেষ্টা করল। ঘরের মধ্যে সব কিছুই কেমন নোংরা হয়ে পড়ে রয়েছে। আগে এমন ছিল না। হাতটা নেড়ে লিজা আমাকে একটা টুল নিয়ে বসতে বলল। আমি বললাম, চিনতে পারছেন?
লিজা ম্লান হাসল। তা পারব কেন? তুমি চলে গেলে আর ম্যাগপিলের আয় কমে গেল। এখানকার কারবারে অনেকে ওকে ঠকালে। মাল নিয়ে গিয়ে আর দাম দিলে না। ম্যাগপিল বাধ্য হয়ে এখান থেকে চলে গেল। আমারও রোজগার কমে গিয়েছে, ঝুড়ির কাজ করে যা তোক কিছু আসত। এখন শোচনীয় অবস্থা, কমবয়সী মেয়েগুলো দয়া করে রেখে দিয়েছে তাই। ওরাই দেখাশোনা করে, ঘরটা ঝাট দিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে গোবেচারা খদ্দের পেলে পাঠিয়ে দেয়।
লিজা এবার পা নাড়াবার চেষ্টা করলে।এখন আমার হাঁটবার অবস্থা নেই। শরীর ভালো, কিন্তু পায়ের কষ্ট। অনেকদিন আগে আমি পড়ে গিয়েছিলাম। হাড় ভেঙে গিয়েছিল। তখন ভালো ডাক্তারকে দেখাতে পারিনি। জোড়াপট্টি দিয়ে তখন ভালো হয়েছিলাম। এখন গোঁজামিল দেবার ফল বুঝতে পারছি।
এই লিজাকে আগেও আমি দেখেছি। তার সঙ্গে বেকার জীবনে আমার যথেষ্ট পরিচয় ছিল। কিন্তু বেচারা মার্কোপোলোর জীবনে অনেকদিন আগে সে-ই যে জড়িয়ে গিয়েছিল তা যদি জানতাম। আমাকে দেখে হয়তো তার পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছে। তাই লিজা এবার গুনগুন করে গান ধরলে। হয়তো এমন কোনো গানের টুকরো যা একদিন কলকাতার প্রমোদবিলাসীদের অন্তরে সাড়া জাগাত। লিজা বললে, দাঁড়াতে পারি না। কোনোরকমে দেওয়াল ধরে ধরে বাথরুমে যাই। মাঝে মাঝে সে শক্তিও থাকে না। তখন বারবারা, প্যামেলা ওরা বেপ্যানের ব্যবস্থা করে দেয়।
আমি নিশ্চল পাথরের মতো এই আশ্চর্য জীবনের দিকে তাকিয়েছিলাম। দুঃখের অনুভূতি এখন আমার মনে আর বেদনা সৃষ্টি করে না। মাঝে মাঝে যখন সত্যিই অভিভূত হই, তখন কসাইখানার কথা মনে পড়ে যায়। নিজেকে কসাইখানার প্রতীক্ষারত অসংখ্য ছাগলের একটা মনে হয়, আমাদেরই কাউকে যেন এই মাত্র সেই ভয়াবহ পরিণতির জন্যে বাইরে নিয়ে যাওয়া হল।
লিজা বললে, কাউকে একটু ডাকি। তোমার জন্যে পাশের দোকান থেকে চা নিয়ে আসুক। হাজার হোক তুমি এখন অতিথি।
আমি বললাম, চায়ের দরকার নেই।
আমার কথায় লিজা বোধহয় কষ্ট পেল। লিজা তার ক্লান্ত এবং স্তিমিত চোখদুটো উজ্জ্বল করবার চেষ্টা করে বললে, ভাবছ খরচা করিয়ে দিচ্ছ। আমার এখন টাকা আছে। কাল রাত্রেই বেশ কিছু রোজগার করেছি।
আমি সত্যিই যেন পাথর হয়ে গিয়েছি। আমার কথা বলার শক্তি লোপ পেয়ে গিয়েছে।
কোথায় কাজ করছ? লিজা প্রশ্ন করলে।
শাজাহান হোটেলে।
শাজাহান! লিজা যেন সত্যিই খুশি হল। আহা ওদের রান্না! একবার খেলে সারাজীবন মুখে লেগে থাকে। ওদের ওমলেট শ্যামপিনো। ওরা তোমাদের বিনা পয়সায় যদি দেয় তাহলে আমাকে একদিন এক প্লেট জাম্বো গ্রীল শাজাহান থেকে এনে দিও তো।
আমি বললাম, একদিন আপনাকে খাওয়াব।
কত দাম? লিজা বিছানায় নড়ে উঠে আমাকে প্রশ্ন করলে।
টাকা সাতেক হবে, আমি বললাম।
অথচ তোমাদের পয়সা লাগবে না! লিজা বিস্মিত কণ্ঠে বললে।
আমাকে পয়সা দিয়েই কিনতে হবে। তবু চুপ করে রইলাম। টাকার কথা শুনলে বেচারা হয়তো খেতে চাইবে না।
চা-এর কাপে চুমুক দিতে কেমন যেন ঘেন্না লাগছিল। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আমার কৃতজ্ঞ মন সহ্য করতে প্রস্তুত থাকলেও অসন্তুষ্ট দেহটা যেন বিদ্রোহ করে উঠছিল।
বললাম, সুশান বলে কাউকে চিনতেন আপনি?
সুশান! সুশান মনরোর কথা বলছ? যে একদিন দোকানে কেক বিক্রি করত? আমারই জায়গায় যে গান গাইতে আরম্ভ করেছিল দশ টাকা মাইনেয়? তাকে চিনি না? বলো কী গো?
আমার মনে হল লিজা সুশানকে তেমন ভালো চোখে দেখে না। লিজা হঠাৎ বললে, তুমি তাকে চিনলে কী করে?
বললাম, একসাইজ ডিপার্টমেন্টের এক বন্ধুর কাছে তার গল্প শুনছিলাম। থিয়েটার রোডে ফ্ল্যাট নিয়ে সে নাকি অনেক টাকা রোজগার করেছিল।