কাল রাত্রে আপনাদের জন্যে আমরা বেশ চিন্তায় পড়েছিলাম। আমি বায়রনের জন্যে চায়ের অর্ডার দিয়ে বললাম।
বায়রন বললেন, কালকের রাত্রিটা হয়তো মার্কো এবং আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
কেন? বেচারা মার্কোর অন্ধকার দাম্পত্যজীবনে কোনো আলোকপাত করতে পারলেন?
বায়রন একবার সন্দিগ্ধভাবে বাইরের দিকে তাকালেন। তারপর বিছানার উপর ভালোভাবে বসে বললেন, ব্যাপারটা তোমার সব মনে আছে? সুশান-এর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের জন্যে মার্কো মনস্থির করেছিলেন। টাকা দিয়ে সুশানকে তার বিরুদ্ধে ডাইভোর্স মামলা দায়ের করতেও রাজি করিয়েছিলেন। চরিত্রহীনতার অভিযোগ প্রমাণের জন্যে লিজা বলে একটি মেয়েরও ব্যবস্থা হয়েছিল। তাকে মার্কো কয়েকটা চিঠিও লিখেছিলেন। তারপর যুদ্ধের ঢেউয়ে সেসব কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছিল কেউ তার খোঁজ রাখেনি।
আমি বললাম, আমার সব মনে আছে। আপনার বাড়িতে বসে মার্কোর হতভাগ্য জীবনের যে বৃত্তান্ত শুনেছিলাম তা কোনোদিনই ভুলব না।
বায়রনের মুখে আজ সার্থকতার আনন্দ দেখলাম। বললেন, সত্যি কথা বলতে কি, আমরা তো কেবল নামে ডিকেটটিভ। পেশাদার সাক্ষী ছাড়া আমাদের বোধহয় কিছুই বলা যায় না। আমাদের ক্লায়েন্টরা সব রকম চেষ্টা করে, হতাশ হয়ে আমাদের কাছে আসেন এবং আশা করেন মন্ত্রের শক্তিতে আমরা তাদের সমস্যার সমাধান করে দেব। পুলিস আমাদের কখনও সন্দেহের চোখে, কখনও করুণার চোখে দেখে। আমরা কোনো সাহায্যই পাই না। ওরা হেসে বলে, ছাগল দিয়ে ধান মাড়ানো হলে কেউ আর বলদ কিনত না! কোনো আশাই করিনি। মার্কোকে যে সত্যিই সাহায্য করতে পারব, তা ভাবিনি।
বায়রনের জানাশোনা একজন প্রতিনিধিই খবরটা এনে দিয়েছিলেন। ছাতাওয়ালা গলির একটা অন্ধকার বস্তিতে সে একজন মেয়ের খবর পেয়েছে যে আগে নাকি রেস্তোরাঁয় গান গাইত। ছাতাওয়ালা গলির নাম শুনে আমার পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল; ওই গলি থেকেই ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট নিয়ে আমি একদিন পথে পথে ঘুরে বেড়াতাম। আমাদের কোম্পানি যে বাড়িতে একখানা ঘর অধিকার করে ছিলেন, তার অন্যান্য মহিলা বাসিন্দাদের জীবনধারণপ্রণালী সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ পোষণের কারণ ছিল।
এবার সত্যিই আমার অবাক হবার পালা। শুনলাম, গতকাল রাত্রে ওঁরা দুজনে সেই মহিলার খোঁজ করতে ছাতাওয়ালা গলিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু মহিলার ঘরে অতিথি ছিল। তারা অনেকক্ষণ বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করেছিলেন। ভেবেছিলেন, অতিথি হয়তো বেরিয়ে যাবে, তখন তারা মোলাকাত করবেন।
আমার পক্ষে এবার চুপ করে বসে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বায়রনও যেন কিছু বুঝলেন। বাড়ির নম্বর জিজ্ঞাসা করলাম, এবং তিনি যেউত্তর দিলেন, তাতেই আমি চমকে উঠলাম।ওই বাড়িটা! ওই বাড়িটা থেকেই তো আমি ঝুড়ি নিয়ে আসতাম।দুপুরে আমাদের কোম্পানির মালিক পিল্লাই প্রায়ই থাকতেন না। কিন্তু তাতে আমার অসুবিধা হত না। বাড়ির করুণ-হৃদয় মহিলারা আমাকে সাহায্য করতেন। ঝুড়িগুলো গুনে গুনে আলাদা করে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিতেন। আমার জলতেষ্টা পেলে তাদের কাছেই চাইতাম, তারা এনে দিতেন।
বায়রন বললেন, এখানকার কোনো খবর রাখো তুমি? কাউকে চেনো?
ও-বাড়িতে একটা মেয়েও নেই, যার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। ওঁরা আমার সহকর্মী ছিলেন। দুপুরে হেঁড়া স্কার্ট পরে, পায়ে খড়ম গলিয়ে নিচু টুলে বসে বসে তারা আমাদের বুড়িগুলো রং করে দিতেন। রংয়ের পর রোদুরে শুকোতে দিতেন। আকাশে মেঘ করলে ওঁদেরই উঠোন এবং ছাদ থেকে বাস্কেটগুলো নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখবার ব্যবস্থা করতে হত। অতি সৎ মহিলারা। বেচারা পিল্লাই-এর সময় ভালো যাচ্ছিল না, কিন্তু মহিলারা তাকে সাহায্য করতেন। যে রেটে অবসর সময়ে তারা ঝুড়ি রং করে দিতেন সে রেটে কোথাও তোক পাওয়া যেত না।
আমার সঙ্গে তারা ভালো ব্যবহার করতেন। প্রায়ই বলতেন, এই রোদে ঘুরে এসেছ, একটু বিশ্রাম নাও, তারপর আবার বেরিও। না হলে শরীর খারাপ করবে। একজন মহিলা বলতেন, আমাদের সম্বল দেহ, আর তোমাদের গতর। এ দুটোই যত্ন করে রাখতে হবে, না হলে খেতে পাবে না।
বাড়ির বাইরে ছোট্ট বোর্ডে লেখা ছিল সাড়ে দশটার পর এই বাড়ির গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। কাউকেই ঢুকতে বা বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। ছাতাওয়ালা লেনের সেই অন্ধকার বাড়িটাতে আমি জীবনের আর এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম। কিন্তু এখানে তার কোনো স্থান নেই, সে অন্য কোথাও হয়তো বলা যাবে।
বায়রন বললেন, একেই বলে ঈশ্বরের ইচ্ছে। ওরা নিশ্চয়ই তোমাকে চিনতে পারবে; তুমি চলল, আমাকে একটু খোঁজখবর দাও।
বায়রনকে নিয়ে সেদিন আমি আমার পুরনো জায়গায় ফিরে গিয়েছিলাম। বায়রন সেই ভোরেই যেতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, এগারোটার আগে গিয়ে লাভ নেই, এখন ওদের দুপুর রাত। সবাই দরজা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছ।
এগারোটার সময় আমাকে দেখে ওরা সবাই প্রায় হই-হই করে উঠেছিল। বাড়িতে ছোট ছোট গোটা পনেরো খুপরি ছিল। কয়েকটা বড় ঘরকে চাচ দিয়ে পার্টিশন করে দুখানা করে নেওয়া হয়েছে। আমার ফর্সা জামাকাপড় দেখেই ওরা বুঝেছিল, আমার জীবনে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। লটারি টিকিট পেয়েছ নাকি? ওরা জিজ্ঞাসা করেছিল।
আমি বলেছিলাম, শাজাহান হোটেলে চাকরি করছি।