ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু আরও বোঝবার আগেই দেখলাম ওঁরা দুজনেই কাঁদতে কাঁদতে একটা গাড়ির মধ্যে গিয়ে উঠলেন। কোনো কথা বলে, শ্রীলেখা দেবীর স্বামী গাড়িতে স্টার্ট দিচ্ছেন।
রাস্তার সামনে দিয়ে গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে যাবার পরে আমার যেন সম্বিৎ ফিরে এলো। হঠাৎ খেয়াল হল, বিলের টাকা দেবে কে? শ্রীলেখা দেবী পেমেন্ট করেননি।
ভয় হল, এই এক রাত্রির দাম হয়তো আমার মাইনে থেকেই কাটা যাবে। কারণ বিল আদায়ের দায়িত্ব আমার। বিল চাইবার কথা ওই অবস্থার মধ্যে আমার মনে একবারও উঁকি মারেনি।
মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এদিকে আলোর রেখা রাস্তার উপরে এসে পড়তে শুরু করেছে।
কালী, কালী, ব্রহ্মময়ী, মা আমার-ন্যাটাহারিবাবু গঙ্গাস্নানের জন্যে নীচেয় নেমে এসেছেন।
আমাকে দেখেই বললেন, মা-গঙ্গায় ড়ুব দেবার অভ্যেসটা করুন। না হলে পাপের অ্যাসিডে জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাবেন। এই যে নিত্যহরি ভটচাজ এত পাপ ঘেঁটেও আজও মাথা উঁচু করে বালিশ বগলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা কেবল এই মাদার গ্যাঞ্জেসের জন্যে। রোজ এই নোংরা বডিটা ধুয়ে কেচে পরিষ্কার করে নিয়ে আসছি। কত ময়লা লাগবে লাগুক না।
আমি চুপ করে রইলাম। নিত্যহরিবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, গরিব বামুনের কথা বাসি না হলে মিষ্টি লাগবে না। মা জননীকেও কতবার বলেছিলাম, যাই করো মা, সকালে মা-গঙ্গাকে একটা পেন্নাম ঠুকে এসো। তা মা আমার কথা শুনলেন না। ইংরেজি শেখা গেরস্ত ঘরের মেয়ে কপালদোষে পাপস্থানে এসেছিল।
ন্যাটাহারিবাবু চোখ দুটো হঠাৎ ধ ধ করে জ্বলতে আরম্ভ করল। আমি কে বলুন তো মশাই? সাতকুলে তোর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, শুধু লিনেন সাপ্লাই করেছি। তা বাবা, থেকে থেকে আমাকেই স্বপ্নে দেখা দেওয়া কেন?
হয়তো আপনি তাকে ভালোবাসতেন, তিনিও হয়তো আপনাকে ভালোবাসতেন, আমি বললাম।
ন্যাটাহরিবাবুর চোখ দুটো ছলছল করে উঠল, তার সযত্নে ঢাকা বেদনাকে আর লুকিয়ে রাখতে পারলেন না। এত বোকা জাত, মশাই দুনিয়ায় দেখিনি। বিষ খাওয়া কী কথা গো? আমার বউ-সে মাগিও বিষ খেয়ে মরেছিল। রাত্রে বাড়ি ফিরিনি বলে। মাকে বলেছিলুম-শিখ পাঞ্জাবিতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, মা বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু বউ আমার বিশ্বাস করলে না। বললে, তোমার মুখে কিসের গন্ধ? বললাম, অনিয়নের গন্ধ।
অনিয়ন? সে আবার কী?বুদ্ধিমতী মেয়ে বোকার মতো প্রশ্ন করলে। রেগে বললাম, অনিয়ন মানে পেঁয়াজ, বাপ তো তোমায় কিছুই শেখায়নি।
তখনও মুখে আমার ভকভক করে দেশি মালের গন্ধ ছাড়ছে। আমার নিজেরই বমি আসবার উপক্রম। বুদ্ধিমতী মেয়ে, ছোটবেলা থেকে অনিয়ন দেখে আসছে, সব বুঝতে পারলে। তারপর ওদের এক অস্ত্র। আমাকে সংশোধন করবার একটা সুযোগও দিলে না। দুনিয়ার মেয়েদের মশায় আর কোনো ক্ষমতা নেই, শুধু বিষ খেতে জানে।
সেই থেকেই ভুগছি। সেই মহাপাপে বাউনের ছেলে সোপার ময়লা দুহাতে ঘেঁটে মরছে। আরও খারাপ হত, হয়তো মাথায় বজ্রাঘাত হত, কিন্তু মা-গঙ্গা রক্ষা করছেন।
ন্যাটাহারিবাবু এবার নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করলেন। তার চোখ দুটো ছলছল করছে। আমার হাতটা তিনি জোরে চেপে ধরলেন। করুণভাবে, পরম স্নেহে বললেন, খুব সাবধান, বাবা। কার কপালে ভগবানের অফিস সুপারিন্টেন্ডেন্ট গুপ্ত সায়েব যে কী লিখে রেখেছেন, কেউ জানে না।
ন্যাটাহারিবাবু বিদায় নিলেন। অস্বস্তিতে আমার মন ভরে উঠল। এতদিনে ন্যাটাহারিবাবুকে যেন চিনতে পারলাম। এক সুদীর্ঘ দুঃস্বপ্নের রাত যেন আমি কোনোরকমে পেরিয়ে এলাম। কিছুতেই আর কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার ইচ্ছা করছিল না।
বেয়ারাকে ডেকে তুলে বললাম, তুমি একটু পাহারা দাও, আমি আসছি।
১৫. ভোর হয়েছে
ভোর হয়েছে। আমাদের ঘরগুলো যেন সূর্যমলনের মধুর সম্ভাবনায় নববধূর সলজ্জ মুখের মতো রাঙা হয়ে উঠেছে।
বোসদা দরজা খুলে দিয়ে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে চা খাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে হাসলেন। ওঁর হাসিতে সব সময়ই আমার জন্যে অনেক আশ্বাস লুকিয়ে থাকে। মনে একটু বল পেলাম।
শ্রীলেখা দেবীর ব্যাপারটা বললাম। তিনি আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, ভয় কী? আমি ওঁর ঠিকানা জানি। দরকার হয় টাকা চেয়ে পাঠাব। তা অবশ্য দরকার হবে না। তিনি নিজেই চেক পাঠিয়ে দেবেন। ঠিক একই ব্যাপার আগেও হয়েছে। স্বামীর ভয়ে রাত্রে এসে আশ্রয় নিয়েছেন, আবার ভোর না হতেই মিটমাট হয়ে গিয়েছে।
আমার পিঠে একটা থাপ্পড় দিয়ে বোসদা বললেন, ন্যাটাহারিবাবুর বিশ্বসংসারে কেউ নেই। তাই এখানে একলা পড়ে রয়েছেন। আমাদের পুরনো ম্যানেজারের হুকুম আছে, ওঁকে যেন কখনও চাকরি ছেড়ে চলে যেতে না বলা হয়। যত বয়সই হোক, শাজাহান হোটেলে ওঁর চাকরি চিরকাল বজায় থাকবে।
বোসদা এবার একটা কাচের গেলাস আমার হাতে দিয়ে বললেন, বাথরুম থেকে গেলাসটা ধুয়ে নিয়ে এসো। একটু দেশি মতে চা খাও। গত রাত্রিটা সত্যিই তোমার খুব খারাপ কেটেছে।
বোসদার ওখানে চা খেয়ে, নিজের বিছানায় এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কতক্ষণ দিবানিদ্রার সুখ উপভোগ করেছিলাম জানি না, হঠাৎ গুড়বেড়িয়ার ডাকে উঠে পড়লাম। গুড়বেড়িয়া বললে, কোন এক সায়েব বলা নেই কওয়া নেই, সোজা ছাদে উঠে এসেছেন।
দরজা খুলে বাইরে উঁকি মারতেই বায়রন সায়েবকে দেখতে পেলাম। তিনি এবার আমার ঘরে ঢুকে পড়লেন। আমাকে সুপ্রভাত জানিয়ে বললেন, আন্দাজ করেছিলাম তুমি এখন ঘুমোবে। তবু চলে এলাম। মার্কোর সঙ্গেও দেখা হয়ে গেল।