হঠাৎ নিজেই হেসে উঠলাম। পাগলের মতো কীসব বকছি? স্যর হরিরাম সম্বন্ধে আমি কতটুকু জানি? হয়তো তিনি গোঁড়া ধর্মভীরু লোক ছিলেন, হোটেলের ধারে কাছেও যেতেন না কখনও। তারপর নিজের ছেলেমানুষিতে নিজে আরও অবাক হয়ে গেলাম। মনে পড়ে গেল, ক্লাইভ স্ট্রিটের এক দারোয়ানজি নিজের অজ্ঞাতে পৃথিবীতে এত লোক থাকতে স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার সঙ্গে আমাকে আত্মীয়তাসূত্রে আবদ্ধ করে দিয়েছেন।
দূরে হোয়াইটওয়ে লাডলোর বাড়ির ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। রাত্রি অনেক হয়েছে। বাড়ি ফেরা দরকার। বাড়ি ফিরতে এখন আমার সঙ্কোচ কী? আমার বাড়ি আছে, আমার আপনজন আছে এবং সবচেয়ে বড় কথা আমার এখন একটা চাকরি আছে।
০৩. পৃথিবীর এই সরাইখানায়
পৃথিবীর এই সরাইখানায় আমরা সবাই কিছুক্ষণের জন্য আশ্রয় নিয়েছি। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ব্রেকফাস্ট খেয়েই বিদায় নেবে, কয়েকজন লাঞ্চ শেষ হওয়া মাত্রই বেরিয়ে পড়বে। প্রদোষের অন্ধকার পেরিয়ে, রাত্রে যখন আমরা ডিনার টেবিলে এসে জড়ো হব তখন অনেক পরিচিত জনকেই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না; আমাদের মধ্যে অতি সামান্য কয়েকজনই সেখানে হাজির থাকবে। কিন্তু দুঃখ কোরো না, যে যত আগে যাবে তাকে তত কম বিল দিতে হবে, বোসদা বললেন।
এ-যে দার্শনিকের কথা হল, আমি বললাম।
হ্যাঁ, এ আমার নিজের কথা নয়—কোনো ইংরেজি কবিতার অনুবাদ। একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক এখানে অনেকদিন ছিলেন, তিনি প্রায়ই লাইনগুলো আবৃত্তি করতেন। আমি যেন কোথায় লিখে রেখেছিলাম। যদি খুঁজে পাই, দেবোখন।
আমি বললাম, সুন্দর ভাবটি তো। যে যত বেশি সময় এই দুনিয়ায় থাকবে সংসারের বিল সে তত বেশি দেবে।
কিন্তু কবি ভদ্রলোক নিশ্চয়ই কোনো হোটেলে চাকরি করেননি। যদি করতেন, তাহলে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার সব ধ্বংস করে, বিলটা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে যে-সব লোক পৃথিবী থেকে সরে পড়েছে, তাদের কথা নিশ্চয় লিখতেন। আর আমাদের কথাও কিছু লিখে যেতেন। আমরা যারা প্রতিদিন ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ এবং ডিনার ধ্বংস করছি, অথচ বিল দিচ্ছি না; কিন্তু গতর খাটিয়ে দেনা শোধ করবার চেষ্টা করছি।
একটু থেমে স্যাটা বোস বললেন, সত্যি কথা বলতে কি, আমি মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠি।
বোসদা বললেন, তাতে অবশ্য কষ্ট পাওয়াই সার হচ্ছে। কারণ হাঁপানিতে কেউ একটা সহজে মরে না। আমাদের যে বেরিয়ে যাবার উপায় নেই। সর্বনাশা এক মোহের আফিম ছড়ানো রয়েছে এখানে। একবার ঢুকলে আর বেরুনো যায় না। দরজা খুলে দিলেও, যাওয়া হয় না।
টাইপ করতে করতে ওঁর কথা শুনে যাচ্ছিলাম।
এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে স্যাটা বোস বললেন, মুখ চোখ বসে গিয়েছে কেন? রোজির ভয়ে রাত্রে ঘুম হচ্ছে না বুঝি?।
সত্যি কথা, বলতে হল।মেয়েটার এখনও খোঁজ নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হঠাৎ এসে না হাজির হয়।
চিন্তারই কথা। বোসদা বললেন। তবে নিজের জমিটা ইতিমধ্যে যত্ন করে লাঙল দিয়ে তৈরি করে রাখো। কর্তাকে খুশি রাখা প্রয়োজন।
কর্তাকে কী করে খুশি রাখতে হয়, তা কর্তার কাছেই শিখছিলাম। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ওমর খৈয়াম কী আর সাধে লিখেছিলেন, এই দুনিয়ায় পাণ্ডিত্যপূর্ণ বড় বড় কেতাব লেখার জন্যে জাঁদরেল পণ্ডিতের অভাব নেই; যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব করবার জন্যে সাহসী পুরুষও অনেক পাওয়া যায়; সসাগরা সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে পারেন এমন রাজনৈতিক প্রতিভাও অনেক আছেন; কিন্তু হায়, সরাইখানা চালাবার লোকের বড়ই অভাব।
হোটেলে প্রতি মুহূর্তে কত রকমের সমস্যারই যে উদ্ভব হয়। সে সব সমাধানের দায়িত্ব বেচারা ম্যানেজারের। চোরদায়ে তিনি যেন সব সময়ই ধরা পড়ে রয়েছেন। স্নানের জল যদি বেশি গরম হয়ে গিয়ে থাকে, তবে বেয়ারাকে খবর না দিয়ে, অনেকে টেলিফোনে তাঁকেই ডেকে পাঠান। হোটেল অতিথিদের অনেকেই শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বাসী; নিম্ন পর্যায়ে আলোচনা করে যে কিছু সমস্যার সমাধান করা সম্ভব, তা তারা মনে করেন না। ফলে, স্নানের জল যদি একটু ঠাণ্ডা হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলেও বেচারা ম্যানেজারের ডাক পড়বে।
ঘুমোতে যাবার সময় কেউ যদি আবিষ্কার করেন, বিছানার চাদরের রং দরজা-জানালার পর্দার রংয়ের সঙ্গে ম্যাচ করেনি তাহলে তিড়িং করে লাফিয়ে ওঠেন। এবং সেই রাত্রেই পাগলের মতো ম্যানেজারকে সেলাম পাঠান। আমার চোখের সামনেই একদিন ঘটনাটা ঘটল। টেলিফোনে এস-ও-এস পেয়ে মার্কোপোলো প্রায় ছুটতে ছুটতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কী ব্যাপার জানবার জন্যে আমিও সঙ্গে সঙ্গে এলাম। নির্দিষ্ট ঘরের দরজায় মার্কোপোলো সায়েব টোকা মারলেন। ভিতর থেকে নারীকণ্ঠে শব্দ এল, কাম্ ইন প্লিজ।
ভদ্রমহিলা মধ্যবয়সী। জাতে ইংরেজিনী। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। ম্যানেজারকে রক্তচক্ষু দেখিয়ে বললেন, আপনারা ডেঞ্জারাস। আপনারা মানুষ পর্যন্ত খুন করতে পারেন। মার্ডারার ছাড়া এমন কালার কম্বিনেশন আর কেউ পছন্দ করতে পারে না! এমন ভয়াবহ রং আমি জীবনে কোনো হোটেলে দেখিনি; আর একটু হলে আমি ফেন্ট হয়ে যাচ্ছিলাম।
রাগে আমার ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছিল। মার্কোপোলো কিন্তু রাগ করলেন না। রাগের নার্ভটা নাকি হোটেল ম্যানেজমেন্ট শিক্ষার ইস্কুলে ঢোকবার সময় কেটে দেওয়া হয়। মার্কোপোলো প্রথমেই হাজারখানেক দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, আহা! আশা করি ইতিমধ্যে আপনার কোনো শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি হয়নি। আমি এখনই তিনটে চাদর পাঠিয়ে দিচ্ছি। তিনটের মধ্যে আপনার যেটা খুশি পছন্দ করে নিন। তবে ওই যে-রংয়ের চাদরটা আপনার বিছানায় পাতা হয়েছে, ওটা আমেরিকান ট্যুরিস্টরা কেন যে পছন্দ করেন জানি না। বাধ্য হয়ে ওই ধরনের চাদর আমাকে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে তৈরি করাতে হয়েছে। কিন্তু তখন কি জানতাম যে আপনি এই ঘরে আসছেন।