এমন সময় হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠল। হ্যালো রিসেপশন? আমি শ্রীলেখা দেবী কথা বলছি।
শ্রীলেখা দেবী কি রাত্রে ঘুমোননি? হয়তো নিজের ঘরদোর ছেড়ে হোটেলে রাত্রি কাটাতে এসে অস্বস্তি বোধ করছেন।
শ্রীলেখা দেবী বললেন, আমার সম্বন্ধে আপনার কাছে কী ইস্ট্রাকশন আছে?
আজ্ঞে, কাউকে আপনি কত নম্বর ঘরে আছেন বলব না। এবং আপনার স্বামী যদি আসেন তাকে যেন তাড়িয়ে দেওয়া হয়।
শ্রীলেখা দেবী দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলেন। প্রশ্ন করলেন, কেউ কি আমার খোঁজ করতে এসেছিল?
এখন রাত্রি রয়েছে, এ-সময়ে কেউ হোটেলে আসে না।
বাজে কথা বলবেন না। হোটেলের কতটুকু দেখেছেন আপনি? মিস্টার স্যাটা বোসকে জিজ্ঞাসা করবেন। এর আগে যতবার রাগ করে চলে এসেছি, আমার স্বামী ততবার এই সময়ে এখানে এসেছেন।
এবার আমার অবাক হবার পালা। শ্রীলেখা দেবী বললেন, আপনি বাইরে একটু খোঁজ করে দেখুন তো। আমি ফোনটা ধরে রইলাম।
কাউন্টার থেকে বেরিয়ে দেখলাম, চিত্তরঞ্জন অ্যাভির উপরেই গরদের পাঞ্জাবি এবং পায়জামাপরা এক ভদ্রলোক কাঠের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ইনিই যে শ্রীলেখা দেবীর স্বামী তা সিনেমা রিপোর্টারদের ক্যামেরার কল্যাণে এদেশের কাউকে বলে দেবার প্রয়োজন নেই। বললাম, আপনি কাকে চান? ভদ্রলোক বিরক্ত হলেন। আমি তো মশাই আপনার হোটেলে ঢুকিনি।
কোম্পানির রাস্তায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছি, তবু গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে এসেছেন?
ফিরে গিয়ে টেলিফোনে খবরটা শ্রীলেখা দেবীকে জানালাম। শ্রীলেখা দেবী এই সংবাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। এই খবর না পেলেই তিনি আশ্চর্য হতেন, হয়তো হতাশায় ভেঙে পড়তেন।
শ্রীলেখা দেবী বললেন, ওঁকে আমার ঘরে পাঠিয়ে দিতে পারেন। আমি আমাদের অসুবিধার কথা বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই শ্রীলেখা দেবী বললেন, কিন্তুর কোনো প্রশ্ন নেই, আপনি ডবল রুমের চার্জ করবেন।
টেলিফোন নামিয়ে রেখে, আবার বাইরে গেলাম। ভদ্রলোক তখনও একটা থাম ধরে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, এক্সকিউজ মি, বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন? ভিতরে আসুন।
ভদ্রলোক তার রক্তচক্ষু এবার আমার দিকে ঘোরালেন।ধন্যবাদ। ভিতরে যাবার কোনো প্রয়োজন হবে না।
এবার জানালাম, শ্রীলেখা দেবী তাকে ঘরে যেতে বলেছেন। আমি তাকে শ্রীলেখা দেবীর ঘর চিনিয়ে দিতে পারি।
যথেষ্ট হয়েছে,ভদ্রলোক উদাসীনভাবে বললেন। পকেট থেকে দেশলাই বের করে ভদ্রলোক এবার একটা বিড়ি ধরালেন। চিত্রজগতের অসামান্য তারকার স্বামীকে বিড়ি ধরাতে দেখে আমি সত্যিই একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
স্ত্রীধন্য ভদ্রলোক তাঁর রাতজাগা ঘোলাটে চোখ দুটো দিয়ে আমাকে গিলে খাবার চেষ্টা করছেন। বললেন, স্বভাবটা একটুও পাল্টাতে দিইনি। দুগগাকে নিয়ে যখন কলকাতায় এসেছিলাম, তখন দুজনে ছোট শাজাহানে খেয়ে গিয়েছি। অত সস্তায় কোথাও খেতে পাওয়া যেত না। তখনও বিড়ি খেতাম, আর এখনও আমি সেই বিড়ি খাই। দুগগাই আপনাদের শ্রীলেখা দেবী হয়েছেন, ছোট শাজাহান ছেড়ে বড় শাজাহানে এসে উঠেছেন। আমার কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয়নি।
ভদ্রলোক কিছুতেই ভিতরে আসতে রাজি হলেন না। সেই থেকে এই চারটে পর্যন্ত যদি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারি, তা হলে আরও কিছুক্ষণ আমার পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হবে না। ভদ্রলোক মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
কাউন্টারে ফিরে আসতে আসতেই শুনলাম টেলিফোনটা আবার বাজছে। শ্রীলেখা দেবীর দেরিও সহ্য হচ্ছে না।হ্যালো, ওঁকে পাঠিয়ে দিয়েছেন?
বলতে হল, উনি আসতে রাজি হচ্ছেন না।
শ্রীলেখা দেবী আর কালবিলম্ব না করে টেলিফোন নামিয়ে দিলেন। আমি মনে মনে বললাম, এ আবার কী ব্যাপার? এই একবস্ত্রে গৃহত্যাগ, আবার রাত না কাটতেই নাটক!
তবে লোকটা কেমন অদ্ভুত ধরনের। চোখ দুটো দেখলে সত্যিই ভয় লাগে।
শ্রীলেখা দেবী যে এখনই নিজের ঘর ছেড়ে কাউন্টারে নেমে আসবেন তা আমার স্বপ্নের অগোচর ছিল। মেক-আপের বাইরে শ্রীলেখা দেবীর সেই মূর্তি আজও আমি ভুলিনি। চুল-টুল উস্কোখুস্কো। মুখেও রাতের সব ক্লান্তি জড়ো হয়ে রয়েছে। যেন স্টুডিওর সেটে কোনো হৃদয়বিদারক দৃশ্যে তিনি অভিনয় করছেন।
শ্রীলেখা দেবী বললেন, আমার ভয়-ভয় করছে। আপনি আমার সঙ্গে দরজা পর্যন্ত একটু আসুন না। বলা যায় না, হয়তো সঙ্গে করে অ্যাসিড নিয়ে এসেছে আমার মুখ পুড়িয়ে দেবে।
এমন অবস্থায় হোটেলের কর্মচারীরও কাঁদতে ইচ্ছা করে। হয়তো পুলিস কেসে জড়িয়ে শ্রীঘর বাস করতে হবে। বেশ ভয় করছিল। বছরের কোনো চাঞ্চল্যকর ফৌজদারি মামলার প্রথম অঙ্ক হয়তো আমারই চোখের সামনে অভিনীত হতে চলেছে।
একবার শ্রীলেখা দেবীকে বারণ করলাম। এমন সময় বাইরে না গেলেই নয়?
শ্রীলেখা কোনো উত্তর দিলেন না। সোজা দরজার দিকে এগোতে লাগলেন। আমাকে বাধ্য হয়ে তার পিছন পিছন চলতে হল।
দরজার কাছে গিয়ে শ্রীলেখা দেবী আমাকে আর যেতে বারণ করলেন। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখলাম শ্রীলেখা দেবী তার স্বামীর দিকে এগিয়ে গেলেন। তার স্বামী রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শ্রীলেখা দেবী এবার স্বামীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ওঁদের মধ্যে যে কী কথা হল, তা দুর থেকে আমার বোঝা সম্ভব ছিল না। হঠাৎ মনে হল শ্রীলেখা দেবী ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। আর তার বিব্রত স্বামী তাকে শান্ত করবার চেষ্টা করছেন।