হোটেলে ফিরতেই সত্যসুন্দরদা বললেন, তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। শুধু শুধু রাত্রে কষ্টভোগ করলে। মার্কোপোলো ফিরে এসেছেন। সঙ্গে মিস্টার বায়রনও ছিলেন। তিনিই ওঁকে ধরে ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে, বেয়ারাদের হাতে জমা দিয়ে চলে গেলেন।
মার্কোপোলো কাউন্টারের সামনে একবার থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। যেন এই হোটেলের তিনি এক নতুন আগন্তুক, এখানকার কিছুই চেনেন না, জানেন না। সত্যসুন্দরদা প্রশ্নকরেছিলেন, কোথায় গিয়েছিলেন, আমাদের সকলের দুশ্চিন্তার সংবাদও প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু যে মার্কোপোলো সারাদিন হোটেল মাথায় করে রাখেন, প্রতিটি খুঁটিনাটির খবর না নেওয়া পর্যন্ত নিজেই নিশ্চিন্ত হতে পারেন না, রাতের অন্ধকারে তিনি কোথায় হারিয়ে গিয়েছেন। তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে সত্যসুন্দরদার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। তারপর প্রশ্ন করেছিলেন, কেন তোমরা সারারাত জেগে থাকো?
সত্যসুন্দরদা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। আপনিই তো ডিউটি চার্টে সই করেন।
মার্কোপোলো হতাশায় মাথা নেড়েছিলেন। বলেছিলেন, ইউজলেস। কোনো মানে হয় না। দুনিয়ার সব লোক যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন এমনভাবে বোকার মতো আসর জাগিয়ে রাখবার কোনো মানে হয় না।
মার্কোপোলোর দৃষ্টি এবার সুজাতা মিত্রের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল। তিনি কিছু বলবার আগেই বোসদা জানিয়ে দিয়েছিলেন, ভদ্রমহিলা হাওয়াই জাহাজের কর্মী, আমাদের অতিথি। মার্কোপোলো সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হয়ে গিয়েছিলেন। আরও কথা বলবার ইচ্ছা ছিল বোধহয়, কিন্তু শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন।
মিস মিত্র বললেন, আমার খুব মজা লাগছিল। প্রতিদিন মাটি থেকে অনেক উঁচুতে মেঘের আড়ালে কত লোককেই তো দেখি। কিন্তু আপনাদের এইখানে আরও অদ্ভুত সৃষ্টির আনাগোনা। ইচ্ছে হয়েছিল, একবার আপনাদের ম্যানেজারকে বলি, রাত্রি আর নেই।
বোসদা প্রথমে হাসলেন, তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, ওঁর জীবনে এখনও রাত্রির অন্ধকার জমা হয়ে রয়েছে। ওঁর জন্যে সত্যিই কষ্ট হয়।
সুজাতা মিত্রকে তখনও কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যে একটু অবাক হয়ে যাইনি এমন নয়। বোসদা বললেন, আপনাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত, কিন্তু ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আপনার গাড়িটা দিলেন, নিজেও এতক্ষণ জেগে রইলেন।
সুজাতা মিত্র আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার গুরুদেব এখন আবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। দেখুন যদি ওঁকে সাহায্য করতে পারেন!
আমি হেসে বললাম, ওটা ধন্যবাদ জানানোর একটা ফর্ম।
সুজাতা মিত্রের পিছনের বেণীটা এবার সাপের মতো দুলে উঠল। বললেন, ফর্মাল লোকদের আমরা তেমন পছন্দ করি না।
বোসদা কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, বচ্ছরকার দিন এইভাবে গালাগালি দিচ্ছেন। এই জন্যেই প্যাসেঞ্জাররা দেশি হাওয়াই হোস্টেস পছন্দ করেন না।
বটে! যদি পছন্দই না করত তা হলে আরও নতুন মেয়ে নেওয়া হচ্ছে কেন?
তা হলে বোঝা যাচ্ছে নতুন যারা ঢুকেছে তারা অনেক ভদ্র এবং ভালো। বোসদা সকৌতুক উত্তর দিলেন।
এ তো উকিলদের মতো কথা বললেন। এখানে আসবার আগে কি আদালতে প্র্যাকটিশ করতেন?
আদালতের কথা তুলবেন না। এ বেচারার মন খারাপ হয়ে যায়। আদালতের সঙ্গে একদিন এর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আমাকে দেখিয়ে বোসদা বললেন।
আমি এবার ঘড়ির দিকে তাকালাম। সুজাতা মিত্রের টানা-টানা দুটো চোখে ঘুমের মেঘগুলো জড়ো হবার চেষ্টা করছে; কিন্তু কিছুতেই তেমন সুবিধে করতে পারছে না। বোসদাও বোধ হয় এবার তা লক্ষ্য করলেন। বললেন, আই অ্যাম স্যরি। অনেক রাত্রি হয়েছে। এতক্ষণ ধরে আপনাকে কষ্ট দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না।
একটাও পোর্টার কাছাকাছি ছিল না। সুজাতা মিত্র নিজেই সুটকেসটা তুলে নিতে যাচ্ছিলেন। আমি আড়চোখে বোসদার দিকে তাকালাম। বোসদা আমার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে, তার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিলেন। সুজাতা বোধহয় একটু অবাক হয়ে গেলেন। কিন্তু বোসদা আমাকে ড়ুবিয়ে দিলেন। বললেন, ছোকরাকে জিজ্ঞাসা করুন। আপনি ব্যাগ বইছেন তো হয়েছে কী? কিন্তু শ্রীমান আমার দিকে এমন কটমট করে তাকাল, যেন আমার মতন এমন সমর্থ কুলি থাকতে কোনো মহিলা তার ব্যাগ বইবেন, তা সে সহ্য করবে না।
সুজাতা মিত্র এবং বোসদা দুজনেই এবার সলজ্জভাবে আমার দিকে তাকালেন। তারপর শাজাহানের দ্বারপ্রান্তে আমাকে একলা প্রহরী রেখে দুজনেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
শাজাহানের নিস্তব্ধ রাত্রি এখন আমার পরিচিত হয়ে গিয়েছে। উনিশ শতকের এই প্রাচীন পান্থশালা আমার নিঃসঙ্গ মুহূর্তে এখন আমাকে আর বিস্মিত করে না। পরিচয়ের অন্তরঙ্গতম পর্যায়ে এসে এই প্রাচীন প্রাসাদ তার কোনো রহস্যই প্রিয়বন্ধুর কাছে গোপন রাখেনি।
কিন্তু সে তো কেবল এই প্রাসাদপুরীর ইট কাঠ পাথরের কথা। এই নাট্যশালার প্রতি প্রকোষ্ঠে, ঠিক এই মুহূর্তেই কত নাটকের শুরু এবং শেষ অভিনীত হচ্ছে, কে তার খোঁজ রাখে? সে-রহস্য সত্যিই যদি কোনো নিস্পৃহ সত্যানুসন্ধানীর চোখে ধরা দিত, তাহলে পৃথিবীর সাহিত্য অসীম ঐশ্বর্যে মণ্ডিত হয়ে আমাদের জ্ঞানচক্ষুকে উন্মীলিত করতে সাহায্য করত।
রাত্রের এই কর্মহীন মুহূর্তের সবচেয়ে বড় কাজ বোধহয় ছড়ি হাতে করে ঘুমকে তাড়ানো, তাকে কাছে আসতে না দেওয়া। তাই চিন্তার এই বিলাসিতাটুকু নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই মেনে নিতে হয়। কিংবা হয়তো শাজাহনের অশরীরী আত্মা বিংশ শতাব্দীর এই আলোকোজ্জ্বল অন্ধকারে আর কাউকে না পেয়ে বেচারা রিসেপশনিস্টের উপর ভর করে, এবং তার চোখের সামনে অতীতের সোনালি সুতোয় এক নয়নাভিরাম চিন্তার জাল বুনতে শুরু করে।