কর্পোরেশন স্ট্রিট পেরিয়ে গাড়ি এবার ওয়েলেসলি স্ট্রিটে পড়ল। আমার আবার বায়রন সায়েবের কথা মনে পড়ে গেল। অনেকদিন তার সঙ্গে দেখা হয় না। দুএকবার দূর থেকে শাজাহানের ব্যাংকোয়েট রুমে তাকে দেখেছি; কিন্তু ইশারায় তিনি কথা বলতে বারণ করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই কোনো শিকারের পিছনে তিনি গোপনে ছুটছেন, হয়তো কাউকে নিঃশব্দে ছায়ার মতন অনুসরণ করছেন। বার-এ এক বোতল বিয়ার নিয়েও তাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখেছি। কিন্তু তিনি আমাকে দেখেও দেখেননি। আমি যে তাকে চিনে ফেলি, এবং তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলি তা তাঁর অভিপ্রেত ছিল না।
তবু অন্য সময়ে তার খোঁজ নেওয়া আমার উচিত ছিল। অন্তত তার বাড়িতে এসে আমার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেসব কিছুই হয়ে ওঠেনি। শাজাহান যেন বিশাল হাঁ করে আমার সর্বস্ব গ্রাস করে ফেলেছে। আমার কোনো পৃথক সত্তা যেন শাজাহানের ক্ষুধা থেকে রক্ষা পায়নি।
ড্রাইভার বললে, কোন দিকে বাবু?
আমি বললাম, তুমি সোজা চলো, সময়মতো আমি দেখিয়ে দেব।
ড্রাইভার বললে, বাবুজি, জায়গা ভালো নয়। এত রাত্রে গাড়ি দেখলে এখানে অনেক রকম সন্দেহ করে।
আমি বললাম, অনেকদিন আগে এখানে এসেছিলাম দিনের আলোয়। পরিষ্কার মনে করতে পারছি না। আর একটু এগোলে হয়তো গলিটা চোখে পড়বে, তখন চিনতে পারব।
শেষপর্যন্ত গলিটা সত্যিই চিনতে পারলাম। সুজাতা মিত্র দয়া না করলে এত রাত্রে ট্যাক্সি চড়ে এখানে আসতে আমার সাহস হত না। হাওয়াই কোম্পানির গাড়িটা কিন্তু গলির মধ্যে ঢুকল না। নেমে পড়ে আমি বায়রন সায়েবের বাড়ির দিকে এগোতে লাগলাম।
একটা টর্চ আনা উচিত ছিল। রাস্তার আলোগুলো পাড়ার ছোকরাদের গুলতির লক্ষ্যস্থল হিসেবে কখনও দীর্ঘ জীবন লাভের সুযোগ পায় না। প্রায় হাতড়াতে হাতড়াতে যেখানে এসে পৌছলাম, সেটাই যে বায়রন সায়েবের বাড়ি তা ভাঙা নেমপ্লেটটা দেখে আমার বুঝতে বাকি রইল না। একটু দূরে একটা রাস্তার আলো অব্যর্থ লক্ষ্যসন্ধানী এলিয়ট রোড বয়েজদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে তখনও যেন কীভাবে টিকে রয়েছে।
বায়রন সায়েবের দরজা বন্ধ। ভিতরেও কোনো আলো জ্বলছেনা। এত রাত্রে তাকে ডেকে তোলা কি উচিত হবে? গঙ্গনাম স্মরণ করতে করতে কলিং বেলটা টিপে ধরলাম।
কোনো সাড়াই পাওয়া গেল না। হয়তো ভিতরে কেউ নেই। একটু ফাঁক দিয়ে আবার বোম টিপলাম।
ভিতরে কে এবার একটু নড়ে চড়ে উঠলেন। তারপর নারীকণ্ঠে ইংরিজি অশ্লীল গালাগালি কানে ভেসে আসতে লাগল : তুমি যেখানকার জঞ্জাল সেখানে গিয়ে থাকো। মাঝরাতে আমাকে জ্বালাতন করতে এসেছ কেন?
আমি ভয়ে জড়োসডো হয়ে দাঁড়ালাম। ভদ্রমহিলা তখন আর এক রাউন্ড ফায়ারিং করছেন। লজ্জা করে না মিনসে, রোজগার করে তো উল্টে যাচ্ছ, আবার রাতেও জ্বালাতন। যাও, ডাস্টবিনে পারিয়া ডগদের সঙ্গে শুয়ে থাকোগে যাও। সারাদিন আমি খেটে মরব, তোমার ভাতের জোগাড় করব, আবার রাতেও খারাপ মেয়েদের মতো জেগে থাকব, সে আমি পারবনা। তুমি দুর হও, দুর হও।
ততক্ষণে সত্যিই আমি ভয় পেয়েছি। মার্কোপোলো তখন মাথায় উঠেছেন। পালাব কিনা ভাবছিলাম। কিন্তু তার আগেই ভিতর থেকে দরজা খোলার শব্দ হল। দরজা খুলেই ঝটা মারতে গিয়ে ভদ্রমহিলা চমকে উঠলেন। স্বামীর বদলে আমাকে দেখে হাউমাউ করে চিৎকার করে উঠলেন।
কী হয়েছে? কী হয়েছে বলো। আমার স্বামীর নিশ্চয় কোনো বিপদ হয়েছে। ওগো, কতবার তোমাকে বলেছি তোমাকে ডিটেকটিভগিরি করতে হবে না। এই পোড়া দেশে ও-সব চলবে না। ওর থেকে তুমি খবরের কাগজ ফেরি করো,
হয় বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকো। আমি যতক্ষণ চাকরি করছি ততক্ষণ তোমার কীসের ভাবনা?
অন্য পল্লি হলে এতক্ষণে সেই কান্না শুনে প্রতিবেশীরা ঘরের দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে আসতেন। কিন্তু এই আধা-সায়েব পল্লিতে ও-সব বড় একটা হয় না। একজনের প্রাইভেসিতে আর একজন মরে গেলেও মাথা ঢোকান না।
মিসেস বায়রন কাতরকণ্ঠে জানতে চাইলেন, আমি পুলিসের লোক, না হাসপাতালের লোক। এত রাত্রে এই দুজন ছাড়া যে আর কেউ তার কাছে আসতে পারে তার্তার কল্পনারও অতীত। বললেন, কোথায় আমার স্বামী আছে বলল, আমি এখনই যাচ্ছি।
আমি এবার কোনোরকমে বললাম, আমি পুলিস বা হাসপাতালের প্রতিনিধি নই। আমি হোটেলের লোক। আমাদের সায়েব মিস্টার মার্কোপোলোকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই খোঁজ করতে এসেছি।
ও! তাই বলল, শ্রীমতী বায়রন আবার নিজমূর্তি ধারণ করলেন। তুমি সেই মোটকা সায়েবের কথা বলছ তো, যে মাঝে মাঝে আমাদের জন্যে স্যান্ডউইচের প্যাকেট নিয়ে আসে। সেমিনসেই তো যত নষ্টের গোড়া। আমাকে বের করে দিয়ে দুজনের গুজ গুজ করে কথাবার্তা চালায়। আমার স্বামী বলেন, ওঁর মক্কেল। আমি কিন্তু বাপু শিকারি বেড়ালের গোঁফ দেখলে চিনতে পারি। সব বাজে কথা। আসলে ওঁর সঙ্গী। দুই সাঙাতে মিলে সেই যে বেরিয়েছে, কোথায় কোন চুলোয় গিয়ে পড়ে আছে কে জানে।
শ্ৰীমতী বায়রন তখনও অশ্লীল গালাগালি বর্ষণ করে চলেছেন। কিন্তু আমার মনে সাহস ফিরে এসেছে। বায়রন সায়েব এবং মার্কোপোলোর তাহলে একটা হদিস পাওয়া গিয়েছে।
শ্ৰীমতী বায়রন বিরক্ত হয়ে বললেন, ও-সব ন্যাকামো ছাড়ো, আমার স্বামী এখন কোথায় আছেন বলো।
আমি বললাম, মিস্টার বায়রন কখন আসবেন, কিছু বলে গিয়েছেন?
কিছু বলে যাননি। ওই মিনসে আসতেই বেরিয়ে গিয়েছে। মুখে আগুন। তোমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বললে আমার পেট ভরবে না। এই বলে শ্রীমতী বায়রন দড়াম করে আমার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন।