সত্যসুন্দরদা এবার অবাক কান্ড করে বসলেন। সত্যসুন্দরদা যে কোনো মেয়েকে এমন কথা বলতে পারেন, তা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। সত্যসুন্দরদা গম্ভীরভাবে বেমালুম বলে দিলেন, অথচ তার জন্যে পরের দিন আপনি একটা থ্যাংকসও দিয়ে যাননি।
প্রত্যুত্তরে সুজাতা মিত্রের মুখে যে হাসি ফুটে উঠেছিল, তা আজও আমার মনে আছে। যেন ভোরের সূর্য সাদা বরফের পাহাড়ের উপর প্রথম আলোর রেখা ছড়িয়ে দিল। সুজাতাদি বললেন, ধন্যবাদ ইচ্ছে করেই দিইনি। যারা নিজের ঘর খুলে অচেনা অতিথিকে শুইয়ে দিয়ে সারারাত জেগে থাকে, তারা নিতান্তই গোঁয়ার, না-হয় বোকা। তাদের ধন্যবাদ দেবার কোন মানে হয় না।
সুযোগ পেয়ে, আইন বাঁচিয়ে, গোয়ার, বোকা, আহাম্মক এতগুলো গালাগালি দিয়ে দিলেন! বোসদা বললেন।
আমাদের দিকে না তাকিয়েই সুজাতা মিত্র বললেন, চমৎকার বানাতে পারেন তো। আহাম্মক কথাটা কেমন উড়ে এসে জুড়ে বসল।
এবার আমাকে উদ্দেশ করে সুজাতা মিত্র বললেন, সেদিন যাবার সময় ধন্যবাদ দেবার জন্য উপরে গিয়েছিলাম। আপনারা কেউ ছিলেন না। এখন দেখছি ভালোই হয়েছিল। আপনাদের মতো লোকের ধন্যবাদ প্রাপ্য নয়। আপনারা সত্যি তার যোগ্য নন।
বোসদা বললেন, আই অ্যাম স্যরি, আপনি যে আমাকে খুঁজেছিলেন, জানতাম না।
আমার তখন বোসদার উপর রাগ হয়ে গিয়েছে। সুজাতাদির পক্ষ দিয়ে বললাম, কী করে জানবেন? দিনরাত হয় ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার, ব্যাংকোয়েট, না-হয় টেবিল বুকিং, ফ্লোর শো নিয়ে ড়ুবে থাকলে অন্য জিনিসের খবর রাখবেন কী করে?
সুজাতা মিত্র বললেন, আপনাদের চোখে কি ঘুম নেই?
বোসদা সুযোগ ছাড়লেন না। উত্তর দিলেন,সাদী বলেছেন, ভালো লোকরা যাতে জ্বালাতন না হন, সেই জন্যে ঈশ্বর দুষ্টদের চোখে ঘুম দিয়েছেন।
সুজাতা মিত্র গম্ভীরভাবে বললেন, রাত্রে কি দুজনকেই জেগে থাকতে হয়?
আমি বললাম, বোসদার জাগবার কথা নয়। কিন্তু আমাদের ম্যানেজারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
বোসদা আমাকে বললেন, ভাবছিলাম থানায় খবর দেব। কিন্তু তাতে অনেক গণ্ডগোল হবার সম্ভাবনা। তাছাড়া এইমাত্র মথুরা সিং-এর সঙ্গে আবার কথা বলে এলাম। শুনলাম, দু-একদিন আগে বায়রন সায়েব এসেছিলেন। দুজনের মধ্যে অনেক কথা হয়েছে। একবার ওঁর সঙ্গে তুমি দেখা করে এসো। আমি যেতে পারতাম, কিন্তু বাড়ি চিনি না। একা-একা এত রাত্রে খুঁজে বের করা বেশ শক্ত হবে। তার থেকে তুমি একটা ট্যাক্সি জোগাড় করবার চেষ্টা করো। আমি তোমার ডিউটি দেখছি।
সুজাতা মিত্র চুপচাপ আমাদের কথা শুনছিলেন। বললেন,আমি একটা কথা বলব? যদি আপত্তি না করেন, তাহলে আমাদের এয়ার লাইনের গাড়িটা নিয়ে যান। ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি। ও নিশ্চয়ই গাড়ির ভিতর শুয়ে আছে।
রাত্রের অন্ধকারে জনহীন পথে কোনোদিন কলকাতার রূপ দেখেছেন কি? দুরন্ত ট্রাম বাস শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়ে কখন কলকাতাকে শান্ত করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে দুএকটা ট্যাক্সি হয়তো দেখা যায়, কিন্তু তাদের মধ্যে কারা? কলকাতার কোনো সাহিত্যানুরাগী ট্যাক্সিওয়ালা আত্মজীবনী লিখলে হয়তো তা জানা যাবে।
চিত্তরঞ্জন অ্যাভিন্যু থেকে আমাদের গাড়ি চৌরঙ্গীতে এসে পড়ল। রাতের নিয়ন আলোগুলো কলের পুতুলের মতো তখনও জনহীন চৌরঙ্গীর রঙ্গমঞ্চে আপনমনে অভিনয় করে চলেছে। কোন এক দুর্বার আকর্ষণে ড্রাইভারকে ডান দিকে গাড়ির মোড় ঘোরাতে বললাম। কার্জন পার্কের লোহার বেড়ার মধ্যে স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কা তখন ইনসোমনিয়াগ্রস্ত শ্ৰেষ্ঠীপতির মতো প্রভাতের প্রতীক্ষায় নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কা আমাকে দেখেও দেখলেন না। এই প্রাচীন নগরীর গোপনতম রহস্যমালা যেন তার হৃদয়হীন ধাতবচক্ষুর কাছে কবে ধরা পড়ে গিয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার নীরস কঠিন দেহে একবিন্দু স্নেহ বা কারুণ্য আবিষ্কার করতে পারলাম না।
কে জানে কেন, পৃথিবীর কোনো মানুষকে আমি এত ভয় করি না। আমার অন্তরের কোথাও তিনি কোনো অজ্ঞাত কারণে সারাক্ষণ উপস্থিত রয়েছেন। নিদ্রাহীন, তৃষিতপ্রাণ হরিরাম দিনে দিনে আরও কঠিন ও কর্কশ হয়ে উঠছেন। তার বিরক্ত চোখের দিকে দুর থেকে তাকালে মনে হয়, স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কা বাহাদুর কে-টি সি আই ই তার সকল অপ্রিয় অভিজ্ঞতার জন্যে পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে আমাকে দায়ী করে বসেছেন। দুনিয়ার যত দুর্বিনীত নিম্নমধ্যবিত্ত তাকে অবহেলা এবং অপমান করবার জন্যেই যেন দল বেঁধে আমাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী খাড়া করেছে, গাড়ি চালিয়ে রাতের অন্ধকারেও তাকে বিরক্ত করতে পাঠিয়েছে।
হয়তো আরও অনেকক্ষণ ছেলেমানুষের মতো স্যর হরিরামের সঙ্গে আমার নীরব কথাবার্তা চলত। কিন্তু এরোপ্লেন কোম্পানির বাস ড্রাইভার আমাকে সাবধান করে দিলে। বললে,বাবুজি, এখানে এত রাত্রে কেউ আসবেন নাকি?
বললাম, না। চলো আমরা এবার এগিয়ে যাই। আমাদের এলিয়ট রোডের দিকে যেতে হবে।
কার্জন পার্ককে বাঁ দিকে রেখে গাড়ি আবার পূর্ব দিকে মোড় ফিরল। স্যর সুরেন ব্যানার্জি যেন মনুমেন্টের তলায় সমবেত লক্ষ লক্ষ জনতাকে উদ্দেশ করে বক্তৃতা করছিলেন। মাইক খারাপ হয়ে গিয়ে তিনি যেন মুহুর্তের জন্যে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন, এবং সেই সামান্য সময়ের মধ্যেই ধৈর্যহীন অকৃতজ্ঞ শ্রোতার দল মিটিং ছেড়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। অবহেলিত এবং অপমানিত সুরেন্দ্রনাথ হতাশায় অকস্মাৎ প্রস্তরে রূপান্তরিত হয়েছেন।