বোসদা বললেন, তুমি নীচে চলে যাও। উইলিয়ম ঘোষ এতক্ষণে নিশ্চয় কেটে পড়েছে। তুমি কাউন্টার সামলাগে যাও। আর একটু অপেক্ষা করে দেখা যাক। হয়তো এখনই ফিরে আসবেন।
আপনি তো এখনই ঘুমিয়ে পড়বেন। তারপর যদি দেখি সায়েব তখনও ফিরছেন না? আমি প্রশ্ন করলাম।
বোসদা হেসে ফেললেন। আমি ঘুমোচ্ছি না। ঘুমটা আমার কাছে অটোমেটিক সুইচের মতো। সুইচ যতক্ষণ না টিপছি শ্রীমানের সাধ্য কি আমার ঘাড়ে এসে চাপে। তুমি যাও।
আমি নীচেয় নেমে এলাম। উইলিয়ম ঘোষ কখন বেয়ারাকে বসিয়ে রেখে বাড়ি ফিরে গেছে।
এখন রাত অনেক। শাজাহান হোটেলও কলকাতার শান্ত সুবোধ শিশুদের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছে। কাউন্টারে কেবল আমি জেগে রয়েছি। আর কলকাতার কোথাও শাজাহানের ম্যানেজার মার্কোপোলো নিশ্চয়ই জেগে রয়েছেন। তিনি কোথায় গেলেন? ড্রাই-ডেতে বেআইনি মদ গিলে কি শেষ পর্যন্ত পুলিসের হাতে পড়লেন? মদ খাওয়াটা অন্যায় নয়; কিন্তু মাতাল হওয়া বেআইনি। রিজার্ভেশনের খাতার দিকে তাকালাম। আজ রাত্রে কোনো অতিথির বিদায় নেবার কথা নেই। রাত্রের অন্ধকারে কয়েকজন নতুন অতিথি কিন্তু আসছেন। দমদম হাওয়াই অফিস থেকে ফোন এসেছে যে, তাদের আসতে সামান্য দেরি হবে। ঠিক এই মুহূর্তে দূর দেশের বিদেশি যাত্রীদের নিয়ে অন্ধকারের বুক চিরে অতিকায় বিমান কলকাতার দিকে এগিয়ে আসছে।
হাওয়াই অতিথিরা যখন এলেন, তখন মুসাফির রাত্রি কলকাতার রহস্যময় পথে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার চোখে কোথা থেকে ঘুম এসে জড়ো হতে শুরু করেছে। ব্যাগ রাখবার শব্দে চমকে উঠলাম। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ঘুমোনো গুরুতর অপরাধ। তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে উঠে দেখলাম, সুজাতা মিত্র।
এয়ার হোস্টেসের আসমানি রংয়ের শাড়ি পরে সুজাতা মিত্র আমার দিকে, তাকিয়ে মৃদু হাসছেন। বললেন, বেচারা।
আমি লজ্জা পেয়ে, সোজা হয়ে উঠে শুভরাত্রি জানালাম। সুজাতাও হেসে বললেন, এখন সুপ্রভাত বলুন। মণিবন্ধের ঘড়িটা সুজাতা মিত্র আমার দিকে এগিয়ে ধরলেন।
হাওয়াই হোস্টেসমিমিত্রের সঙ্গীরা খাতায় সই করে ভিতরে চলে গেলেন। সুজাতা মিত্র তাদের বললেন, ডোন্ট ওয়ারি। আমি একটু পরেই যাচ্ছি।
সুজাতা মিত্র বললেন, আপনার অবস্থা দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে। লজ্জা পেয়ে আমি বললাম, মিস্ মিত্র, আমার মোটেই ঘুম পাচ্ছে না। টানা টানা চোখ দুটো আরও বড় করে সুজাতা মিত্র পরম স্নেহে বললেন, আহা রে। আমাকেও কাস্টমারের মতো খাতির করে কথা বলতে হচ্ছে।
আমি খাতার দিকে তাকাতে তাকাতে বললাম, আপনাকে এবার খুব ভালো ঘর দিয়েছি, মিস্ মিত্র। রুম নাম্বার দুশো তিরিশ। গতবার রাত্রে এসে আমাদের মিস্টার বোসের ঘরে থেকে আপনি শাজাহান সম্বন্ধে যে খারাপ ধারণা করেছিলেন, এবার তা নষ্ট হয়ে যাবে।
হাওয়াই হোস্টেস সুজাতা সহজেই সবাইকে আপন করে নিতে পারেন। আমার মতো একজন অপরিচিত সামান্য হোটেল কর্মচারীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতেও তার কোনো আপত্তি নেই। অথচ শাজাহানে তার সমগোত্রীয়া আরও অনেককে তো দেখেছি। তাদের হাইহিলের ঠোকরে শাজাহানের মাটি কম্পমান।
সুজাতামি আমার কথায় যে একটু রাগ করেছেন, তা বোঝা গেল।বললেন, হোটেলে যে বেশিদিন কাজ করেননি, তা তো আপনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এরই মধ্যে এসব প্রফেশন্যাল কথা এমন কায়দাদুরস্তভাবে কেমন করে শিখলেন?
আমার বেশ ভালো লাগছিল।ওঁর আন্তরিকতা অজ্ঞাতেই মনকে স্পর্শ করে। হেসে বললাম, এত অল্প সময়ের মধ্যেই যে কাজ শিখতে পেরেছি, তার একমাত্র কারণ মিস্টার স্যাটা বোস।
সুজাতা মিত্র আমার কথা শেষ করতে দিলেন না। হাসতে লাগলেন। বললেন, অদ্ভুত নাম তো।
বোসদার বিরুদ্ধে কেউ সামান্য ব্যঙ্গ করলেও আমার মনে লাগে। কোথাকার একটা হাওয়াই জাহাজের মেয়ে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে, ভাবতেও আমার রাগ হচ্ছিল। বললাম, ওঁর আসল নাম তো স্যাটা নয়। হোটেলে কাজ করতে করতে নামটা অমন বেঁকে গিয়েছে। সত্যসুন্দর বোস, কুলীন কায়স্থ।
সুজাতা মিত্র প্রখর বুদ্ধিমতী। আমার মুখ দেখেই সব বুঝে নিলেন। ঠোঁটের কোণে হাসি চেপে রেখে বললেন, আপনাদের এই হোটেল তা হলে তো মোটেই নিরাপদ জায়গা নয়। কোথায় সত্যসুন্দর আর কোথায় স্যাটা। আপনি খুব সাবধান। কোন্ দিন দেখবেন আপনিও হয়ে গিয়েছেন সাঁকো। সায়েবরা হয়তো আপনাকে স্যাংকে বলে ডাকতে আরম্ভ করেছেন।
আমি ছেলেমানুষীর বশে রেখে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, বটে। কেউ আমার নামে হাত দিয়ে দেখুক না। তখন তার একদিন কি আমার একদিন।
সুজাতা মিত্র হাসতে হাসতে বললেন, আপনার দাদাটি তত বেমালুম নিজের নামটা হাতছাড়া করলেন।
আমি রেগে বললাম, বেশ করেছেন। তাঁর নিজের নাম, তা নিয়ে তিনি যা খুশি করবেন, তাতে কার কী?
সুজাতা মিত্র বললেন, সেবারে আপনাদের কিন্তু খুব ভুগিয়ে গিয়েছিলুম। ভাবলে এখনও আমার লজ্জা লাগে।
হয়তো সুজাতামিত্র আরও কথা বলতেন। কিন্তু হঠাৎ তিনি একটু গম্ভীর হয়ে উঠলেন। বোসদা যে কখন আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল করিনি।
বোসদা প্রথমে বললে, আরে, আপনি! এই ছেলেটা রাতদুপুরে আপনাকে বকিয়ে বকিয়ে মারছে তো। বকতে পেলে শ্রীমান আর কিছুই চায় না।
সুজাতা মিত্র বললেন, উনি নিজেকে আপনার সুযোগ্য শিষ্য বলে পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করেন। অনেক ঠোঁটের ভদ্রতা আপনার কাছ থেকে শিখেছেন। সে-রাত্রে আপনি নিজের ঘর খুলে দিয়ে আমাকে থাকতে দিলেন; আর এখন কি না আপনার শিষ্য ভদ্রতা করে বলছেন, নিশ্চয়ই আপনার কষ্ট হয়েছিল, এবারে ভালো ঘর দিচ্ছি।