আমি সত্যিই বিস্মিত হয়েছিলাম। সত্যসুন্দরদার মধ্যে এমন একটা হতাশ মন যে এমন ভাবে লুকিয়ে আছে, তা জানতাম না। সত্যসুন্দরদা শাজাহানের ছাদ থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন; বললেন, আকাশের দিকে এমনভাবে যুগ-যুগান্ত ধরে তাকিয়ে থাকলে একদিন হয়তো উত্তর পাওয়া যেতে পারে—আমরা কেন এমন, অন্তরের ঐশ্বর্য বিসর্জন দিয়ে সমাজের তথাকথিত সেরাদের অনেকে কেন এই বার এবং ক্যাবারেতে ভিড় করে।
বোসদা আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়েই বললেন,যুগযুগান্ত ধরে মানুষ অভাব-অনটনকে জয় করার সাধনা করে এসেছে। সে ভেবেছে প্রতিদিনের জীবনধারণের সমস্যা সমাধান করলে তবেহয়তে পরম নিশ্চিন্তে একদিন আপন আত্মার উন্নতির সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু কী হল? যাদের জীবনধারণের দুশ্চিন্তা নেই, যাদের অনেক আছে, তারাই অন্তরে নিঃস্ব হয়ে শাজাহানের রঙিন আলোয় নিজেদের হাস্যকর করে তুলছে। রিডিকুলাস, রিডিকুলাস, বোসদা নিজের মনেই বললেন।
স্তম্ভিত আমার তখন কথা বলবার সমার্থ্য নেই। বোসদা বললেন, আলড়স হাক্সলে এক বইতে ভারতবর্ষ ভ্রমণের বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করেছেন। বোম্বাই-এর কোন হোটেলে বই-এর দোকানে তিনি এক বিশেষ শাস্ত্র সম্বন্ধে অজস্র বই দেখেছিলেন। Rows of them anddozens of copies of each. অথচ হোটেলে যে ওই-বিষয়ে উৎসাহী ডাক্তারা বই কিনতে আসেন এমন নয়। হালে লিখলেন, সাধারণ লোকরাই ওই সব বই কেনে। Strange, strange phenomenon! Perhaps it is one of the effects of climate.
বোসদা বললেন, আমিও ভেবেছিলাম জল-হাওয়ার দোষ। কিন্তু পরে ভেবেছি হাক্সলে সায়েবের নিজের দেশই বা কম যায় কীসে? এ প্রশ্নের কী উত্তর জানি না। তবে ডি এইচ লরেন্সের লেখায় এর সামান্য উত্তর পেয়েছি, পুরো নম্বর দিলেও তাকে পাশ নম্বর দেওয়া যায় : the God who created man must have a sinister sense of humour, creating him a reasonable being yet forcing him to take this ridiculous posture, and driving him with blind craving for this ridiculous performance.
বোসদাকে আজ যেন বলার নেশায় পেয়েছে।কোনো সহজ উত্তর বোধহয় নেই। জীবনের প্রশ্নপত্র অসংখ্য ছেলে-ঠকানো কোশ্চেনে বোঝাই। ওসব বোঝবার চেষ্টা করতে গেলে পাগল হয়ে যেতে হবে। তার থেকে শ্রীলেখা দেবীর কথা শোনো।
আপনি শুতে যাবেন না? আমি প্রশ্ন করলাম।
যাব। তুমি তো নাইট ডিউটি দিতে নীচেয় যাচ্ছে। সুতরাং জেনে রেখে দাও।শ্রীলেখা দেবীর স্বামী রাত্রে হয়তো হাজির হতে পারেন। উনিই তখন ফোন করেছিলেন। ভদ্রলোকও একটা ঘর চাইছিলেন। আমি বলে দিলাম, ঘর খালি নেই। ভদ্রলোককে বিশ্বাস নেই। ওঁর ভয়ে বেচারা শ্রীলেখা দেবীর জীবনে একটুও শান্তি নেই। উনি বলেছেন, তোমার সুন্দর মুখের গর্বে তুমি ফেটে পড়ছ। তোমার ওই মুখে আমি অ্যাসিড ঢেলে দেব। বলা যায় না হয়তো রাত্রে হাজির হতে পারেন। যদি আসেন, কিছুতেই ঢুকতে দেবে না।
বোসদা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মনে হল অন্ধকারে কে যেন আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
ছায়ামূর্তিকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে প্রথম যে একটু ভয় পেয়ে যাইনি তা নয়। একটু পরেই বোঝা গেল, ছায়ার মালিক মার্কোপোলোর বেয়ারা মথুরা সিং। মথুরাকে কোনোদিন আমাদের খোঁজে ছাদে উঠে আসতে দেখিনি। মথুরা মুখ শুকনো করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল।
সে আমাদের সেলাম করলে। বললে, বাবুজি, আপনারা এখনও ঘুমিয়ে পড়েননি?
গুমোবার উপায় নেই মথুরা, আমার রাত ডিউটি।
মথুরা বললে, ঘুমিয়ে পড়লে আপনাদের ডেকেতুলতে হত। এমন ব্যাপার কখনও তো হয়নি।
আমরা মথুরার মুখের দিকে তাকিয়ে শুনলাম, মার্কোপোলো সেই যে সন্ধ্যাবেলায় বেরিয়েছেন, এখনও ফেরেননি।
হঠাৎ আজ বেরোলেন কেন? মথুরাকে প্রশ্ন করলাম।
আজ যে ডেরাই ডে বাবু। কোথা থেকে গিয়ে সায়েব ধেনো খেয়ে আসবেন। কিন্তু বাবু, এতদিন থেকে দেখছি, কখনও এত রাত্রি করেননি।মথুরা সিং মুখ শুকনো করে বললে।
সত্যসুন্দরদাও যেন চিন্তিত হয়ে উঠলেন। বললেন, সায়েব তত বেশ ফ্যাসাদ বাধালে দেখছি। তা জিমি সায়েবকে খবর দিয়েছ? তিনিই তো শাজাহান হোটেলের দুনম্বর, যদি কিছু করবার থাকে, তাকেই করতে হবে।
মথুরা সিং মানুষ চেনে। সেবিষণ্ণ মুখে হাসল। আস্তে আস্তে বললে, আমরা ছোট চাকরি করি হুজুর, আমাদের বলা উচিত নয়। জিমি সায়েবকে আপনারা তো চেনেন, ম্যানেজার সায়েবের কোনো ক্ষতি হলে উনি সবচেয়ে খুশি হবেন।
বোসদা গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। তারপর কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, তুমি যাও। দেখি কী করা যায়।
মথুরা চলে যেতে বোসদা বললেন, মথুরার মানুষ চিনতে বাকি নেই। জিমিটাকে ঠিক বুঝে নিয়েছে। লোকটার অন্তহীন লোভ। বেয়ারাদের কাছ থেকে পর্যন্ত টিপসের ভাগ নেয়। কেউ সাহস করে বলতে পারে না, এখনই চাকরি খেয়ে নেবে। মার্কোপোলো বুঝেও কিছু বলেন না—হাজার হোক পুরনো লোক, ওঁর অনেক আগে থেকে হোটেলে চাকরি করছে। মার্কোপোলোর আর ঠিক আগেকার উদ্যম নেই। ক্রমশ কেমন হয়ে পড়ছেন। দিনরাত চুপচাপ বসে থেকে কী সব ভাবেন। আর সেই সুযোগে জিমিটা পুকুর চুরি আরম্ভ করে দিয়েছে। একজন কিছুটা খবর রাখে, সে হল রোজি। কিন্তু তাকেও জিমি হাতের মুঠোর মধ্যে রেখে দিয়েছে।
আমি বললাম, বিদেশ বিভুয়ে ভদ্রলোক একা পড়ে রয়েছেন। একটা কিছু করা দরকার। হাজার হোক আমাদের নিজেদের শহর।