আমি বললাম, কিছুই বুঝতে পারছি না, বোসদা।
বোসদা উত্তর দিলেন, এই স্যাটা বোসও পারে না। বইতে বলছে-ইতিহাসের চরিত্রগুলো সত্য, আর ঘটনাগুলো মিথ্যা। আর উপন্যাসে, গল্পে, নাটকে চরিত্রগুলো মিথ্যা, কিন্তু ঘটনাগুলো সত্য।
আমি প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বোসদা নিজেই প্রতিবাদ তুললেন, কথাটা নির্ভেজাল সত্য নয়, কিছুই অতিশয়োক্তি আছে। কিন্তু এও ঠিক যে, সমাজের সব সত্য ইতিহাসের বইতে পাওয়া যায় না।
হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। বোসদা বললেন, এতক্ষণ য়ুনিভার্সিটির হে অফ দি ডিপার্টমেন্টের মতো লেকচার দিচ্ছিলাম! ভগবানের সহ্য হল না। মনে করিয়ে দিলেন যে,আমিশাজাহান হোটেলেরহরিদাস পাল রিসেপশনিস্ট।
টেলিফোন ধরে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, স্যাটা বলছি।…নিশ্চয়ই, আপনার কোনো চিন্তা নেই, আপনি চলে আসুন।
টেলিফোন নামিয়ে বোসদা খাতা খুললেন। খাতায় একটা ঘর বুক করলেন।
বললাম, এখন কে আসছেন?
বোসদা বললেন,এমন একজন যাঁর এই কলকাতাতেই ফ্যাশনেবল পল্লিতে বাড়ি আছে, সে-বাড়ির অনেক ঘর খালি পড়ে রয়েছে। তবু তিনি আসতে চান। এই রাত্রের আশ্রয়ের জন্য সামান্য হোটেল-কেরানির পায়ে পড়তেও তিনি রাজি আছেন।
ব্যাপার কী? আমি প্রশ্ন করলাম।
বিপুলা এ-পৃথিবীর কতটুকু জানি! বোসদা মাথা নাড়লেন। তার নাম শুনলে, কত লোক এখনি এই হোটেলে ছুটে আসবে। আমরা সবাই তাকে চিনি।
একটু পরে আবার টেলিফোন বেজে উঠল। আমি ফোন ধরতেই পুরুষালি গলায় এক ভদ্রলোক বললেন, আজ রাত্রে কোনো ঘর পাওয়া যাবে?
বোসদা আমার হাত থেকে টেলিফোন নিয়ে বললেন, আপনার নাম? তারপর এক মিনিট চুপ করে থেকে বললেন, স্যরি, কোনো উপায় নেই।
টেলিফোন নামিয়ে দিতেই আমি ওঁর দিকে তাকালাম। কারণ আজ আমাদের কয়েকটা ঘর খালি রয়েছে। অথচ বোসদা বেমালুম বললেন, কিছুই খালি নেই।
মাত্র কিছুক্ষণ পরেই যাঁকে শাজাহান হোটেলের কাউন্টার এসে দাঁড়াতে দেখলাম, রূপালি পর্দায় ছাড়া অন্য কোথাও তাকে যে দেখব তা স্বপ্নেও ভাবিনি। তিনি চিত্রজগতের উজ্জ্বল তারকা শ্রীলেখা দেবী। সিনেমার পত্র-পত্রিকায় তার বহু মন-কেমন-করা ছবি আমি দেখেছি। আমাদের হোটেলে কিন্তু মাত্র একবার তার নাম বোসদার মুখে শুনেছিলাম। কোন এক পার্টিতে ফোকলা চ্যাটার্জি এই সুন্দরীশ্রেষ্ঠার গায়ে বমি করে দিয়েছিলেন। পার্টির মধ্যেই শ্রীলেখা দেবীকে উঠে গিয়ে শাড়ির আঁচল ধুয়ে বাড়ি চলে যেতে হয়েছিল। ঘেন্নায় তার তখন ফেন্ট হবার মতো অবস্থা! ফোকলা চ্যাটার্জি ক্ষমা প্রার্থনা করতে গিয়েছিলেন, শ্রীলেখা দেবী, কিছু মনে করবেন না।নতুন ককটেল ট্রাই করতে গিয়ে আমার এই অবস্থা হল। ব্যাটারা ককটেলের নাম দিয়েছে ফিল্মস্টার কিন্তু ও-সব
দেখতেই ভালো, কাছে আনতেই বমি হয়ে গেল, কিছুতেই সহ্য করতে পারলাম না।
শ্রীলেখা দেবী কিন্তু শোনেননি। সোজা বলে দিয়েছিলেন, ফোকলা যে পার্টিতে থাকবে সেখানে তিনি যাবেন না। বেচারা ফোকলাকে সেই থেকে ফিল্ম পার্টিতে কেউ নেমন্তন্ন করে না।
ফোকলা দু একবার আমাকে বলেছেন, কী হাঙ্গাম বলুন দেখি মশাই। মানুষের শরীর বলে কথা, মাঝে মাঝে গা বমি বমি করবে না? অথচ শ্রীলেখা দেবীর ধারণা, আমি ইচ্ছে করেই ওঁর গায়ে বমি করে দিয়েছিলাম। আপনার সঙ্গে তো জানা-শোনা আছে, ওঁকে একটু বুঝিয়ে বলবেন?
ফোকলা চ্যাটার্জি তখন নেশার ঘোরে ছিলেন। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলেছিলেন, ঠিক হ্যায় মশায়, এ শর্মার নাম ফোকলা চ্যাটার্জি। মাল খেতে না ডাকলে হয়তোবমি করতে পারব না। কিন্তু কুলকুচি? কোন দিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আপনাদের দেবীর মুখে কুলকুচির জল ছড়িয়ে দেব, মুখের সব পাউডার তখন ধুয়ে বেরিয়ে গিয়ে আসল রূপ বেরিয়ে পড়বে, আর একটিও কন্ট্রাক্ট পাবে না।
ফোকলা চ্যাটার্জি সেদিন বিশ্বাস করেননি, কিন্তু শ্রীলেখার দেবীর সঙ্গে আমার সত্যিই পরিচয় ছিল না। আজ প্রথম দেখলাম। বোসদা ওঁকে নমস্কার জানালেন। তারপর খাতা দেখে ওঁর ঘরের নম্বর বলে দিলেন।
শ্রীলেখা দেবী বলেছিলেন, আমাকে একটা কাপড় কিনে দিতে পারেন? এত রাত্রে? দোকানপাট তো সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বোসদা বললেন।
শ্রীলেখা দেবী বললেন, এক বস্ত্রে বেরিয়ে এসেছি। কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি।
চিত্রজগতের ইতিহাসে আমার এক বিশিষ্ট অবদান আছে। তাদের প্রখ্যাত অভিনেত্রীর জন্যে আমি ধর্মতলা স্ট্রিটের এক পরিচিত দোকানের দারোয়ানকে জাগিয়ে প্রায় মধ্যরাত্রে শাড়ি কিনে এনেছিলাম। অতি সাধারণ শাড়ি। কিন্তু তাই পেয়েই শ্রীলেখা দেবী যেন ধন্য হয়ে গিয়েছিলেন।
রাত্রে ছাদে বসেছিলাম। বোসদা বলেছিলেন, শ্রীলেখা দেবী জীবনে অনেক শাড়ি পরেছেন, তার অনেক শাড়ি থেকে দেশের ফ্যাশন তৈরি হয়েছে, কিন্তু এই শাড়িকে তিনি কোনোদিন ভুলবেন না।
বোসদা আরও বলেছিলেন, ভাবছি, এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা নোট বইতে লিখে রাখব। যদি কোনোদিন আত্মজীবনী লিখি কাজে লেগে যাবে! এই সত্যসুন্দর বোস সেদিন বো-টাই আর স্যুট ছেড়ে দিয়ে ধুতি পাঞ্জাবি চড়িয়ে রাতারাতি সাহিত্যিক বনে যাবে। দলে দলে গুণমুগ্ধ ভক্ত এই আদিঅকৃত্রিম স্যাটা বোসের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেবে।
লেখেন না কেন? আমি অভিযোগ করেছি।
লিখে কিছুই করা যাবে না। বোসদা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, শুনেছি, লেখার জোরে পৃথিবীর কত পরিবর্তনই না হয়েছে, সভ্যতা বারেবারে লেখকের ইঙ্গিতেই নাকি মোড় ফিরেছে। আমি কিন্তু বিশ্বাস করি না। লেখার জোরে এই অন্ধ, বোবা, বৈশ্য সভ্যতার কিছুই করা যাবে বলে মনে হয় না। মাইক দিয়ে চিৎকার করো, মহাভারতের মতো আড়াই সেরি বই লিখে ফেললা, হাজার পাওয়ারের বাতি দিয়ে দোষের উপর আলো ফেলো, তবুও কিছু হবে না।