এক এক সময় আবার অন্য চিন্তা মনের মধ্যে জট পাকিয়ে যায়। শাজাহান হোটেলে প্রতিদিন অতিথিদের যে জোয়ারভাটা খেলে, তাদের কোনো পরিচয় তো আমার রচনায় রেখে যেতে পারলাম না। যাদের অতি নিকট থেকে দেখলাম, যাদের সুখদুঃখের সঙ্গে আমার সুখদুঃখ জড়িয়ে গিয়েছিল, কেবল তাদের কথাই লিখলাম। অথচ যে বিশাল জীবনস্রোত প্রতিদিন আমার বিস্মিত চোখের সামনে দিয়ে প্রবাহিত হল, দর্শকের আসর থেকে তাকে কেবল দেখেই গেলাম, তার সংবাদ পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিলাম না। অনাগত কালে কোনো বিরল-প্রতিভা হয়তো বঙ্গভারতীর সেই অতি প্রয়োজনীয় অভাব দূর করবেন। তার লেখনীস্পর্শে পান্থশালার বহু মানুষের কলধ্বনি অতীতের গর্ভ থেকে উদ্ধার পেয়ে বর্তমানের কাছে ধরা দেবে, তীব্র ঘৃণাদায়ক অসুন্দরের মধ্য থেকে সাহিত্যের পরমসুন্দর ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করবেন। কাউন্টারে সেদিন কোনো কাজ ছিল না। চুপচাপ বসে বসে এই সব কথাই ভাবছিলাম। এমন সময় বোসদার হাতের স্পর্শে চমকে উঠলাম। বোসদা হেসে বললেন, কী এত ভাবছ?
বললাম, কেমন অবাক হয়ে যাচ্ছি। এই হোটেলে কোনোদিন যে ঢুকতে পারবতা স্বপ্নেও ভাবিনি; অথচ অন্দরে ঢুকে এই সামান্য সময়ের মধ্যেই নিজের অজ্ঞাতে কখন আমার সত্তা শাজাহানের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।
বোসদা আবার হাসলেন।তোমরা যে সব সায়েব হয়ে গিয়েছ-পূর্বজন্মে বিশ্বাস করো না। না হলে বলতাম, আমি এখানে আরও কয়েকবার এসেছি। এই হোটেলের প্রতিটি ঘরের সঙ্গে আমার জন্মজন্মান্তরের পরিচয় রয়েছে।
হয়তো তাই। আমি বললাম, হয়তো আমিও এখানে আগে এসেছিলাম। হয়তো এমনিভাবেই কোনো বিষণ্ণ নয়না করবী গুহকে আমি দেখেছিলাম। হয়তো আরও কত কনি এবং সাদারল্যান্ডের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল।
আরও কতজনের সঙ্গে হয়তো পরিচয় হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হয়নি, বোসদা খাতা লিখতে লিখতে বললেন। তবে এইটুকু বলতে পারি, আমাদের চোখের সামনেও অনেক অবিস্মরণীয় মুহূর্তের সৃষ্টি হয়, কিন্তু আমরা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে নিজের কাজেই মত্ত থাকি, তার খেয়াল করি না।
আমি ঠিক বুঝতে না পেরে, বোসদার মুখের দিকে তাকালাম। বোসদা হাসতে হাসতে বললেন, মাঝে মাঝে আমি ১৮৬৭ সালের কথা ভাবি। আমাদের নয়, অন্য হোটেলের কথা। কিন্তু আমাদেরই মতো কোনো এক রিসেপশনিস্টের চোখের সামনে নিশ্চয় তা ঘটেছিল। সেদিনের সেই রিসেপশনিস্টও নিশ্চয় আমাদেরই মতো খাতার মধ্যে ড়ুবে ছিল, এবং পায়ের শব্দে চমকে উঠে আগন্তুককে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। একি! এমন অতিথি তো সাহেবি হোটেলে কখনও দেখা যায় না! ভদ্রলোকের গায়ে উড়নি, ভিতরে পৈতে দেখা যাচ্ছে, পায়ে লাল চটি। হয়তো রাস্তা চিনতে না পেরে নেটিভ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এখানেই ঢুকে পড়েছেন। কিংবা, যা দিনকাল, কিছুই বলা যায় না। হয়তো পণ্ডিতও বার-এ বসে ফরাসি দেশের দ্রাক্ষাকুঞ্জের সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপন করতে চান!
রিসেপশনিস্ট নিশ্চয়ই তার অভ্যস্ত কায়দায় সুপ্রভাত জানিয়েছিল এবং পণ্ডিতের সুগম্ভীর ইংরিজি উত্তরে অবাক হয়ে গিয়েছিল। আই ওয়ান্ট টু সি মিস্টার… পণ্ডিত বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই চিরাচরিত প্রথা মতো রিসেপশনিস্ট ভিজিটরস স্লিপ এগিয়ে দিয়েছিল। গোটা গোটা অক্ষরে পণ্ডিত সেখানে নাম লিখে দিয়েছিলেন। স্লিপের দিকে তাকিয়ে, আমরা যেভাবে আজও উত্তর দিই, ঠিক সেইভাবে সেদিনের হোটেল-রিসেপশনিস্ট নিশ্চয় উত্তর দিয়েছিল, ও মিস্টার ডাটু! যিনি সবে বিলেত থেকে এসেছেন? জাস্ট এমিনিট!
রিসেপশনিস্ট নিশ্চয়ই এই ব্রাহ্মণকে জানতনা।কেনইবা এসেছেন?হয়তো বা সামান্য সাহায্যের আশায়। রিসেপশনিস্ট তবুও তাকে বসতে বলেছিল। আরও কয়েকজন ভদ্রলোক হোটেলের নতুন অতিথির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য এসেছিলেন।
লাউঞ্জে এসে অতিথি অন্য সকলের সঙ্গে করমর্দন করলেন, কিন্তু পণ্ডিতকে দেখে দুহাতে গলা জড়িয়ে মুখ চুম্বন করলেন এবং আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাকে বুকে চেপে ধরে ক্রমাগত চুম্বন ও নৃত্য করতে লাগলেন। অপ্রস্তুত পণ্ডিত বলতে লাগলেন, আরে করো কি, করো কি, ছাড়ো। বোসদা এবার থামলেন। আমাদের হোটেলের কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন, মাইকেল মধুসূদন ও বিদ্যাসাগরের সেই দৃশ্যের কথা চিন্তা করলে আজও রিসেপশনিস্ট হিসাবে আমার দেহে এক বিচিত্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়। আমাদের এই শাজাহানেও এমনই কত নাটকীয় মুহূর্তে আমরা হয়তো উপস্থিত ছিলাম, কিন্তু খেয়াল করিনি। তবে মধুসূদনের হোটেলের সেই রিসেপশনিস্টকে আমি হিংসে করি। অসংখ্যের মধ্যে এতদিন পরে আজও তাকে আমরা মনে রেখেছি। আর সবাই বিস্মৃতির অতলগর্ভে কোথায় তলিয়ে গেল, যেমন আমরাও একদিন যাব।
বোসদার হাত ধরে আমিও ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই হারিয়ে যাওয়া মধ্যাহ্নে ফিরে গিয়েছিলাম। চোখের সামনে মাইকেল মধুসূদন এবং ঈশ্বরচন্দ্রকে দেখতে পাচ্ছিলাম। আর ভাবছিলাম আজও আমার চোখের সামনে যে-সব ঘটনা ঘটছে, কে জানে তারাও একদিন হয়তো ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে।
বোসদা নিজের মনেই চিন্তা করছিলেন। বললেন, কোথায় যেন পড়েছিলাম ইতিহাসের দুটো অংশ—একটা ফলাও করে লেখা হয়, ছাপা হয়। আর একটা চিরদিনই অলিখিত থেকে যায়। সবাই তা জানে, অথচ কেউই তা প্রকাশ করতে সাহস করে না। আমরা বোধহয় আমাদের চোখের সামনে সেই দ্বিতীয় অধ্যায়ের ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ্য করছি।