একেবারে নির্ভেজাল হুইস্কি। যেন গলা দিয়ে নামতে নামতে সব জ্বালিয়ে দেয়।
বেয়ারারা একা সব সামলাতে পারছিল না। তাই সরাবজি নিজেও ছোটাছুটি করছিলেন। এমন সময় কার আবির্ভাবেমাতালদের মধ্যে যেন চাপা গুঞ্জন উঠল।
কে? চমকে উঠে সরাবজি দেখলেন তাঁর মেয়ে।
তুই? তুই এখানে? সরাবজি কোনোরকমে বললেন।
মেয়ে বাবাকে চমকে দেবার জন্যেই এসেছিল। বাবাকে সঙ্গে করে বাড়ি ফিরবে। আর কদিন? তারপর কতদিন আর বাবার সঙ্গে দেখা হবে না। অথচ এখন বাবার পাশে বসে বসে গল্প করতে ইচ্ছে করছে। জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে, বাবা, তুমি যখন অনাথ আশ্রমে ছিলে তখন তোমাদের মাখন দিত?
বাবা বলবেন, না মা, মাখন কোথায়। তিন টুকরো পাউরুটি কেবল।
মেয়ে নিজেও এমন দৃশ্য কোনদিন দেখেনি। একটা বিরাট কড়ার মধ্যে কতকগুলো অপ্রকৃতিস্থ লোক যেন টগবগ করে ফুটছে। বাবার হাতের পেগ মেজারটা কেঁপেউঠেকিছুটামদ টেবিলে পড়ে গেল। মেঝেতে যে লোকটা পড়ে ছিল সেও এবার উঠে বসে চিৎকার করে বললে, আমিও একটা বড়া পেগ চাই।
মেয়ে স্তম্ভিত। আনন্দ করে বাবাকে নিয়ে পালাবে বলে ঠিক করেছিল। তার মুখে কে যেন কালি ছিটিয়ে দিয়েছে। বাবা, আমার সঙ্গে যাবে না?
মেয়ের হাত ধরে বাবা রাস্তায় বেরিয়ে এলেন, তার দেহ কাঁপছে। কোনোরকমে বলেছেন, তুমি বাড়ি যাও। এখন বার বন্ধ করবার উপায় নেই। ওরা রেগে গিয়ে সব ভেঙে দেবে।
বাড়িতে ফিরে এসে সরাবজি দেখেছিলেন মেয়ে শুয়ে পড়েছে।
পরের দিন মেয়ের সামনে যেতে তার ভয় করেছে। মেয়ের কাছে তিনি ধরা পড়ে গিয়েছেন।
বিলেত যাবার দিন এগিয়ে এসেছে। কিন্তু মেয়ে কেমন মনমরা হয়ে আছে। সভ্যতার সর্বনাশা রশ্মি যেন মেয়েটার নরম মনকে একেবারে পুড়িয়ে দিয়েছে। সরাবজি ভেবেছেন, মেয়েকে গিয়ে জড়িয়ে ধরবেন। বলবেন, কেন মা তুই এ-সব ভাবছিস, তুই পড়াশুনা কর। তুই কত বড় হবি।—কিন্তু কিছুই বলতে পারেননি।
তারপর যাবার দিনে ভোরবেলায় বোধহয় বাবা ও মেয়ের একান্তে দেখা হয়েছিল। মা তখন ঘুমিয়ে। বাবা নিভৃতে মেয়ের ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন। তুই কিছু বলবি? তোর মুখ দেখে কদিন থেকে মনে হচ্ছে তুই আমাকে কিছু বলতে চাস।
মেয়ের ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠেছে। কোনোরকমে বলেছে, আমার ভয় করছে, বাবা। যাদের সেদিনকে তোমার দোকানে দেখে এলাম তাদের মা, বোন, স্ত্রী, মেয়েরা হয়তো চোখের জল ফেলছে। তারা কি আমাদের ক্ষমা করবে?
বাবা চমকে উঠেছিলেন। বলতে গিয়েছিলেন, আমি কী করব? আমার কী দোষ? আমি তো আর ওদের টেনে নিয়ে এসে বার-এ ঢোকাচ্ছি না। আমি সৎপথে ব্যবসা করি। কিন্তু কিছুই বলতে পারেননি।
মেয়ে ট্রেনে চড়ে বোম্বাই গিয়েছে। এবং সেখান থেকে জাহাজে বিলেত। কিন্তু সরাবজি নিজের জালে জড়িয়ে পড়েছেন। তিনি চোখের সামনে শুধু মেয়ের বিষণ্ণ মুখ দেখতে পেয়েছেন। মেয়ে যেন তাকে প্রশ্ন করছে—তারা কি তোমায় ক্ষমা করবে?
মনের দ্বন্দে কাতর হয়ে পড়েছেন সরাবজি। নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, আমি কি বলেছি তোমরা অত পেগ খাও। এক পেগ খেয়ে উঠে গেলেই পারো। আমি কী করব, আমি না খাওয়ালে তোমরা অন্য দোকানে গিয়ে খাবে। তবু মেয়ে যেন তাকে প্রশ্ন করছে। তিনি মনে মনে বলেছেন, ওদের স্ত্রী আর মেয়েরা তো বারণ করলেই পারে। আমি কী করব? আমি সামান্য মদের ব্যবসায়ী, যত দোষ আমারই হল?
কিন্তু কিছুতেই পারেননি। যতই উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন ততই যেন একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্ন তার মনের মধ্যে গেঁথে বসেছে। সেই চিহ্নটা ক্রমশ বড় হয়ে উঠেছে। . সরাবজি ভয় পেয়ে গিয়েছেন। স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছেন—যত লোক তার দোকানে এসেছে তাদের মা, বোন, বউ, মেয়ে সবাই চোখের জলে তাকে অভিশাপ দিচ্ছে। সেই অভিশাপের বিষবাষ্প শুধু তাকে নয়, তার সংসার, এমনকী তার মেয়েকেও গ্রাস করছে।
সরাবজি পাগলের মত হয়ে উঠেছেন, তারপর একদিন মরিয়া হয়ে বার বিক্রি করে দিয়েছেন। সেই রাত্রেই মেয়েকে তিনি চিঠি লিখতে বসেছিলেন, আমার কী দোষ? ওরা যদি নিজে এসে দোকানে বসে মদ খেয়ে নিজেদের সংসার নষ্ট করে থাকে, তাতে আমার কী দোষ?
এইখানেই শেষ হলে ভালো হত। বিক্রির টাকাটা ব্যাঙ্কে রেখে সরাবজি ছোট্ট সংসার চালিয়ে নিতে পারবেন ভেবেছিলেন।
কিন্তু সেখানেই মুশকিল হল, ব্যাঙ্ক ফেল পড়ল; যেদিন বিক্রির চেকটা ব্যাঙ্কে জমা দিয়েছিলেন তার দুদিন পরে।
হয়তো অভিশাপ, হয়তো চোখের জলের ফল।
সরাবজি কী করবেন? মেয়েকে তার পড়াতে হবে। অবশিষ্ট যা আছে তাতে মেয়েকে বিলেতে রাখা যাবে না। কাজ চাই। কিন্তু ক্লাশ ফোর পর্যন্ত পড়া লোককে কে চাকরি দেবে?
তাই ঘুরে ফিরে আবার বার। সরাবজি ফিসফিস করে আমাকে বললেন, এবার আমি তো চাকরি করছি। আমি কী করব? যদি কোনো অভিশাপ কেউ দেয় সে নিশ্চয় আমাকে লাগবে না।
সরাবজির চোখে নিশ্চয়ই জল ছিল না। কিন্তু আমার মনে হল সেখানে দুফোটা জল রয়েছে। সবজি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি চোখ বুজে ঈশ্বরকে বোধহয় আর একবার প্রশ্ন করছেন, চাকরি করলে নিশ্চয়ই কোনো দোষ নেই? আমাকেও তো সংসার প্রতিপালন করতে হবে।
আত্মদ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হতভাগ্য সবজি উঠে পড়ে এবার নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলেন। আর আমি সংসারের সৌরমণ্ডলে এক নতুন জ্যোতিষ্ক আবিষ্কারের আনন্দে বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম।
১৪. নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয়
এক এক সময় নিজেকে আমার খুব স্বার্থপর মনে হয়। আমার কর্ম-জীবনের সঙ্কীর্ণ পৃথিবীতে যারা একদিন পদার্পণ করেছিল তাদের সুখ-দুঃখের এই সুদীর্ঘ বিবরণ আমার ভালো লাগলেও লাগতে পারে; কিন্তু তার মধ্যে পাঠক-পাঠিকাদের কেন টেনে আনলাম? আবার ভাবি, ফোকলা চ্যাটার্জি, মিসেস পাকড়াশী, মিস্টার আগরওয়ালার গতায়াত কিছু আমার পৃথিবীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তাদের সঙ্গে সবার পরিচয় হওয়াই ভালো।