সরাবজির সঙ্গে ক্রমশ আমার পরিচয় নিবিড় হয়েছে। বুঝেছি, তার মধ্যে বুদ্ধির শাণিত তীক্ষ্ণতা নেই। কিন্তু সৎপথে থাকার তীব্র বাসনা আছে, আর আছে ঈশ্বরে অগাধ বিশ্বাস।
সরাবজি যেন আজও সব বুঝতে পারেন না। অন্তরের দ্বন্দ থেকে আজও মুক্ত হতে পারেননি তিনি। এবং সে গল্পের শেষ অংশ আমি তার নিজের মুখেই শুনেছিলাম।
বার-এর এক কোণে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন-কবে এই বার-পর্ব শেষ হবে, সুরা-পিয়াসীদের মনে পড়বেতাদেরও বাড়ি আছে, সেখানে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। তারা বিল চুকিয়ে উঠে পড়বে, বারম্যানরা চেয়ারগুলো ঠিক করে রাখবে, আমি ক্যাশ বন্ধ করে হিসেব করব, তারপর ছুটি।
সরল মানুষ সরাবজি। বললেন, বাবুজী, আমার তো লেখাপড়া হয়নি। কিন্তু যারা পড়াশোনা করে, যারা চিন্তা করে, তাদের আমার খুব ভালো লাগে। আমার স্ত্রীর কাছে আমি দুঃখ করি।সরাবজি আমাকে প্রশ্ন করলেন, তোমরা তো তবু বই-টই পড়ো। মানুষ কেন হুইস্কি খায় বলতে পারো?
আমি বললাম, মিস্টার স্যাটা বোসের ধারণা, হুইস্কির মধ্যে ভীরু সাহস খোঁজে, দুর্বল শক্তি খোঁজে, দুঃখী সুখ খোঁজে, কিন্তু অধঃপতন ছাড়া কেউই কিছু পায় না।
ছোটছেলের মতো সরল বিশ্বাসে সরাবজি হেসেছিলেন। সরাবজি প্রশ্ন করে ছিলেন, আচ্ছা, আমরা যারা মদ বিক্রি করি তাদের সম্বন্ধে কেউ কিছু বলেননি?
আমি পরম বিস্ময়ে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। উনি চেয়ারে বসে পড়ে বলেছিলেন, আমি তোমাকে সব বলছি। হয়তো তুমি বুঝবে। লেখাপড়া জানি
বলে আমি নিজে উত্তর খুঁজে পাইনি। আমার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করতে পারতাম, সে অনেক লেখাপড়া শিখেছে। কিন্তু নিজের মেয়েকে এ-সব জিজ্ঞাসা করা যায়?
মেয়েকে সত্যিই ভালোবাসেন সবজি। তার জীবন মরুভূমিতে একমাত্র মরূদ্যানের মতো সে। বলেছেন, তুমি আমার মেয়েকে জানো না। এমন বুদ্ধিমতী এবং পণ্ডিত মেয়ে তুমি কোথাও পাবে না। এবং সে সুন্দরীও বটে। সরাবজি বেশ গর্বের সঙ্গে বললেন।কত মোটা মোটাবই যে সে পড়ে। জানো, সে রোজ আমাকে চিঠি লেখে। আমারও খুব বড় বড় চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমি যে লেখাপড়া শিখিনি, আমার যে বানান ভুল হয়। মেয়ের কাছে লিখতে লজ্জা হয়। মেয়ে অবশ্যি বলে, বাবা, তুমি ওসব নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাবে না। তুমি আমাকে বড় বড় চিঠি লিখবে। জানো, সে এখন বিলেতে পড়ছে। যে ক্লাশ ফোর পর্যন্ত পড়ে অনাথ আশ্রম থেকে এসেছিল, তার মেয়ে। গর্বে বৃদ্ধ অশিক্ষিত সরাবজির বুক ফুলে উঠল।
কোনো মহাপুরুষ বলেছিলেন, পৃথিবীতে যত রকমের প্রেম আছে তার মধ্যে মেয়ের প্রতি বাবার ভালোবাসা সবচেয়ে স্বর্গীয়। He beholds her both with and without regard to her sex। স্ত্রীর প্রতি আমাদের ভালোবাসার পিছনে কামনা আছে, ছেলের প্রতি ভালোবাসার পিছনে আমাদের উচ্চাশা আছে, কিন্তু মেয়ের প্রতি ভালোবাসার পিছনে কিছুই নেই। বইতে পড়া কথাগুলোই আজ সরাবজির মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠতে দেখলাম।
সরাবজির দুঃখের কথা সেদিনই শুনেছিলাম। সরাবজি কোনোদিন স্ত্রী বা মেয়েকে বার-এ আসতে দেননি।
সকাল নটা পর্যন্ত বাড়িতে থাকতেন তিনি। তারপর বাজার নিয়ে রেস্তোরাঁয় আসতেন। দুপুরে বাড়ি থেকে ভাত আসত। বিকেলে একবার চা খাবার জন্যে বাড়ি যেতেন। তারপর শুরু হত বার-পর্ব। যত রাত বাড়বে তত সমস্যা বাড়বে। সাড়ে দশটায় দরজা বন্ধ করা প্রতিদিনই সমস্যার ব্যাপার। অনেকে উঠতে চায় না। অনেকে বলে, বার খুলে রাখো। বলতে হয়, খুলে রাখবার লাইসেন্স নেই। লোকে গালাগালি করে, গেলাস ভাঙে। সরাবজি দেখতে পারেন না। কয়েকজনের জন্যে রিকশা বা ট্যাক্সি ডেকে দেন। নেশার ঘোরে হয়তো গাড়ি চাপা পড়বে।
লোকগুলো যখন আসে কেমন সুস্থ। হাসে,নমস্কার করে, কেমন আছে খবর নেয়। কিন্তু তারপরেই ধীরে ধীরে রং বদলাতে শুরু করে।কতবার ইচ্ছে হয়েছে, বলেন, সামান্য একটু খেয়ে বাড়ি ফিরে যান। হাউস গার্লরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে। কিন্তু বলতে সাহস হয় না।
মেয়ে বলেছে, বাবা, তোমার দোকানে যাব। না মা, ওখানে যেতে নেই। ওখানে আমার অনেক কাজ, খুব ব্যস্ত থাকতে হয়।
কেন বাবা, গেলে কী দোষ হয়?
ছিঃ, অবাধ্য হয়ো না মা, ওখানে যেতে নেই।
বড় হয়েছে মেয়ে, ফুলের মতো বসন্তের সৌন্দর্য নিয়ে ফুটে উঠেছে তাঁর মেয়ে। কত বুদ্ধি, কত জ্ঞান, কত বিদ্যা অথচ কত সরল। সংসারের কিছুই জানে না। মেয়ে কতবার বলেছে, বাবা, তোমার মতো আমিও ব্যবসা করব। বাবা বলেছেন, মা মা, তুমি প্রফেসর হবে। বিরাট পণ্ডিত হবে। দেশ-বিদেশের লোকরা বলবে, ওই মুখ লোকটার মেয়ে কত শিখেছে।
মেয়ের বিলেত যাওয়ার সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। মেয়েকে ছেড়ে সরাবজি কেমন করে অতদিন থাকবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না, কিন্তু উপায় কী? ডক্টর মিস সরাবজি হয়ে তার মেয়ে যেদিন আবার ফিরে আসবে, সেদিন? সেদিন তো কাগজে তার মেয়ের ছবি বেরিয়ে যাবে।
কিন্তু সে রাত্রে মেয়ের যে কী হল। সরাবজির বার-এ তখন তান্ডব-নৃত্য শুরু হয়েছে। মেঝের উপর তখন একজন শুয়ে পড়েছে। মুখ দিয়ে গাঁজা বেরোচ্ছে। বেঞ্চের উপরদুজন গুম হয়ে গেলাস নিয়ে বসে আছে। বলছে, বেয়ারা, আউর এক পেগ লে আও।
বেয়ারা বলেছে, হুজুর, এই পেগের বিলটা। আমরা কী করব হুজুর, একসাইজ আইন। বিল পরের পর আসবে, আর মিটিয়ে দিতে হবে। সরাবজি কাছে গিয়ে প্রশ্ন করছিলেন, আপনাকে কী দেব?।