মথুরা বললে, বাবুজি, ব্যারিস্টার সায়েবের কাছে তো অনেক দেখেছেন! এবার এখানেও দেখুন। শিউ ভগবানের দয়ায় আপনার চোখের পাওয়ার তো কমে যায়নি।
চায়ের পেয়ালা নামিয়ে বললাম, মথুরা, এখানে ছুটি কখন হয়?
বাবুজি, ব্রিটিশ রাজ্যে তবু কোভি কোভি সান-সেট হোয়, কিন্তু হোটেলের আলো কখনও নেভে না। ছুটি এখানে কখনই হয় না। তবে আপনাকে কতক্ষণ কাজ করতে হবে, কিছু বলেনি?
বললাম, না।
আজ প্রথম দিন তাহলে চলে যান। মথুরা বললে।
ম্যানেজার সায়েবের সঙ্গে দেখা করে যাই। আমি বললাম।
ওঁর দেখা তো এখন পাবেন না হুজুর। মথুরা বললে।
কেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
আমার এই আকস্মিক প্রশ্নের জন্যে মথুরা যেন প্রস্তুত ছিল না। সে বেশ বিব্রত হয়ে পড়ল। কী উত্তর দেবে সে ঠিক করে উঠতে পারছে না। এখন ওঁর ঘরে কারুর ঢুকবার অর্ডার নেই, মথুরা ফিসফিস করে বললে। আপনি চলে যান, উনি জিজ্ঞাসা করলে, আমি বলে দেব।
আপিস ঘর থেকে বেরিয়ে করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ির সামনে হাজির হলাম। ঘরের ভিতর সব সময় আলো জ্বালা থাকে, তাই বুঝতে পারিনি, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি এসেছে। শাজাহান হোটেলে আলোগুলো যেন মেছোবাজারের গুন্ডা। ভয় দেখিয়ে, চোখ রাঙিয়ে নিরীহ রাত্রিকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, ঘরে ঢুকতে দেয়নি।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখলাম কার্পেটের উপর প্রতি পদক্ষেপে হোটেলের নাম লেখা। কাঠের রেলিংটা এত মসৃণ যে ধরতে গিয়ে হাত পিছলে গেল। সিঁড়ির ঠিক বাঁকের মুখে একটা প্রবীণ দাদামশায় ঘড়ি আপন মনে দুলে এই হোটেলের প্রাচীন আভিজাত্যের সংবাদ ঘোষণা করছে।
অতিথিরা লিফটে সাধারণত ওঠা-উঠি করেন। দু-একজন ক্রীড়াচ্ছলে সঙ্গিনীর হাত ধরে নৃত্যের তালে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুতবেগে উপরে উঠে যাচ্ছেন। একবার ধাক্কা খেতে খেতে কোনোরকমে বেঁচে গেলাম।
রিসেপশন কাউন্টারে বেশ ভিড়। সত্যসুন্দর বোস তখনও কাজ করছেন। টেলিফোনটা প্রায় প্রতিমুহূর্তেই বেজে উঠছে। লাউঞ্জের সব চেয়ার এবং সোফাগুলো বোঝাই।
আমাকে দেখতে পেয়ে ওরই মধ্যে একটু চাপা গলায় বোস বললেন, সারাদিন ম্যানেজারের আপিসেই পড়ে রইলেন?
বললাম, প্রথম দিন, অনেক কাজ ছিল।
মিস্টার বোস কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পোর্টারের মাথায় মাল চাপিয়ে একদল নতুন যাত্রী কাউন্টারের সামনে এসে হাজির হলেন।
আচ্ছা, পরে কথা হবে, বলে বিদায় নিলাম।
দরজার সামনে মেডেল-পরা দারোয়ানজি তখন দ্রুতবেগে একের পর এক সেলাম উপটৌকন দিয়ে চলেছেন।
গাড়ি-বারান্দার সামনে একটা সুদৃশ্য বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে। হলিউডে তৈরি ইংরিজি ছবিতেই এমন বাস দেখেছি। আমাদের এই বুড়ি কলকাতাতেও যে এমন জিনিস আছে, তা জানা ছিল না। কলকাতার বাসদের মধ্যে কোনোদিন যদি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা হয়, তাহলে এই বাসটাই যে মিস ক্যালকাটা হবে তা জোর করে বলতে পারি। পোর্টাররা পিছন থেকে মাল নামাচ্ছে। আর বাস-এর সামনের দরজা দিয়ে যাঁরা নেমে আসছেন তারা যে কোনো বিমান প্রতিষ্ঠানের কর্মী, তা দেখলেই বোঝা যায়। মাথার টুপিটা ঠিক করতে করতে পুরুষ এবং মহিলা কর্মীরা ভিতরে ঢুকে যাচ্ছেন। ওঁদের পাশ কাটিয়ে, সেন্ট্রাল এভিন ধরে আমিও হাঁটতে শুরু করলাম।
আমার সামনে চৌরঙ্গী। চৌরঙ্গীর রাত্রি যেন কোনো নৃত্যনিপুণা সুন্দরী। দিন ওখানে রাত্রি। রাত্রি ওখানে দিন। সন্ধ্যার অবগাহন শেষ করে সুসজ্জিতা এবং যৌবনগর্বিতা চৌরঙ্গী এতক্ষণে যেন নাইট ক্লাবের রঙ্গমঞ্চে এসে নামলেন। ওদিকে কার্জন পার্কের অন্ধকারে কারা যেন দেশনায়ক সুরেন্দ্রনাথকে বন্দি করে বেঁধে রেখে গিয়েছে। এই দুষ্টের দল জাতীয়তার জনককে যেন তার প্রিয় কন্যার নির্লজ্জ নগ্নরূপ না দেখিয়ে ছাড়বে না। বৃদ্ধ দেশনায়ক অপমানিত বন্দি দেহটাকে নিয়ে অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঘৃণায় এবং অবজ্ঞায় আর কিছু না পেরে শুধু মুখটা কোনোরকমে দক্ষিণ দিকের অন্ধকারে ফিরিয়ে নিয়েছেন।
হাঁটতে হাঁটতে কার্জন পার্কের পশ্চিমতম প্রান্তে স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার কাছে এসে দাঁড়ালাম। স্যর হরিরাম এখনও সেই ভাবে রাজভবনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। যেন প্রশ্ন করছেন, বণিকের মানদণ্ড কি সত্যই রাজদণ্ড থেকে দুর্বল?
ইতিহাসের এই অভিশপ্ত শহরে শত শত বৎসর ধরে কত বিচিত্র মানুষের পদধূলি পড়েছে। নিঃস্ব হয়ে বিশ্বে এসে তাদের কতজনই তো অফুরন্ত বৈভবের অধিকারী হলেন। তাদের রক্ত বিভিন্ন, ভাষা বিভিন্ন, পোশাক বিভিন্ন কিন্তু লক্ষ্য একই। আর মহাকাল যেন বিশ্বকর্পোরেশনের হেড ঝাড়ুদার, ঝাঁটা দিয়ে খ্যাত-অখ্যাত, ধনী-দরিদ্র, দেশি-বিদেশি সবাইকে মাঝে মাঝে সাফ করে বিস্মৃতির ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছেন। শুধু দুএকজন সেই ঝটাকে ফাঁকি দিয়ে কোনোরকমে বেঁচে রয়েছেন। এই মৃত্যুমুখর ভাগীরথী-তীরে কয়েকজনের প্রস্তরীভূত দেহ তাই আজও টিকে রয়েছে। সেই মৃত শহরের মৃত নাগরিকদের অন্যতম স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কাকে নমস্কার করে বললাম, কাল আপনি আমাকে যে অবস্থায় দেখেছেন, আজ আমার সে অবস্থা নেই। আমি কাজ করছি। শাজাহান হোটেলে। আপনি যখন বেঁচেছিলেন, এই শহরের বাণিজ্য সাম্রাজ্য যখন পরিচালনা করছিলেন, তখনও শাজাহান হোটেলের রাত্তিরটা দিনের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠত। আপনি নিজেও নিশ্চয় সেখানে অনেকবার গিয়েছিলেন।