নিজের চেয়ারে বসে মার্কোপোলো চুরুট ধরালেন। দীর্ঘ পুরুষালি দেহ। বয়সের তুলনায় শরীরটা একটু ভারী। মাথায় সামান্য টাক। কিন্তু চুলটা ছোট করে ছাঁটা বলে, টাকটা খুব চোখে পড়ে না। চুরুটের গুণে গম্ভীর মুখটা আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। থিয়েটারে উইনস্টন চার্চিলের ভূমিকায় ওঁকে সহজেই নামিয়ে দেওয়া যায়।
চিঠি ডিক্টেশন দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে, মার্কোপোলো আমার মুখের দিকে তাকালেন। গভীর দুঃখের সঙ্গে বললেন, সাচ এ গুড় গার্ল। রোজির মতো মেয়ে হয় না। ওর জন্য আমার আপিসের কাজে কোনো চিন্তাই ছিল না। যখনই ডেকেছি, হাসিমুখে চিঠি টাইপ করে দিয়েছে—এমনকি মিডনাইটেও। হোটেলে এমন সব চিঠি আসে যা ফেলে রাখার উপায় নেই, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে হয়।
মার্কোপোলো এবার দু একটা চিঠি ডিক্টেশন দিলেন। ইংরাজি খুব ভালো নয়, কিন্তু বিনয়ের পরাকাষ্ঠা। কোথায় যে কী পানীয় পাওয়া যায় তার পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর যে তিনি রাখেন তা বুঝতে পারলাম। সম্প্রতি কয়েকটি মদ ডাইরেক্ট ইমপোর্ট করিয়েছেন। তাই একটা সার্কুলার ডিক্টেশন দিয়ে সগর্বে ঘোষণা করলেন—এই বিশ্ববিখ্যাত পানীয় ভারতবর্ষে একমাত্র আমরাই আমদানি করতে সমর্থ হয়েছি।
ডিক্টেশন শেষ করে ম্যানেজার সায়েব আবার বেরিয়ে পড়লেন। অনেক কাজ বাকি রয়েছে। বড় হোটেল চালানো থেকে একটা ছোটখাটো রাজত্ব চালানো অনেক সহজ। যদি দুশো জন অতিথি এখানে থাকেন, তাহলে প্রতি মিনিটে দুশো সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে। এবং সে-সবের সমাধান ম্যানেজারকেই করতে হবে।
চিঠি টাইপ করা আমার নতুন পেশা নয়। সুতরাং ওই কাজে বেশি সময় ব্যয় করতে হল না। সই-এর জন্য চিঠিগুলো সায়েবের ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে, আপিসের কাগজপত্তরগুলো গুছোতে আরম্ভ করলাম। হঠাৎ পালিয়ে গিয়ে রোজি আমাকে ড়ুবিয়ে গিয়েছে। কোথায় কী আছে জানি না। কোথায় কোন ফাইল আছে তারও কোনো লিস্টি খুঁজে পেলাম না। কেবল মাত্র একজোড়া চোখ এবং দুটো হাতের উপর ভরসা করে ফাইলের পাহাড় আবার ঢেলে সাজাতে আরম্ভ করলাম।
আমার টেবিলের বাঁদিকে ড্রয়ারগুলো খুলতেই দেখলাম রোজির ব্যক্তিগত মালপত্তর কিছু রয়েছে। একটা নেলপালিশ, নতুন ব্লেড এবং একটা ছোট আয়নাও ওখানে পড়ে রয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কার জন্য ফাইলগুলো সাজাচ্ছি? আগামী কালই হোটেলে সর্বজনপ্রিয় যুবতী মহিলাটি হয়তো আবার আবির্ভূতা হবেন; তখন আমাকে আবার কার্জন পার্কে ফিরে যেতে হবে। দুদিনের জন্য মায়া বাড়িয়ে লাভ কী?
কাজের মধ্য দিয়ে দিনটা যে কোথা দিয়ে কেটে গেল, খেয়াল করিনি। ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চের ঘর পেরিয়ে ঘড়ির কাটা কখন যে সান্ধ্য চা-এর সময়ও অতিক্রম করে যাচ্ছিল, তা নজরে আসেনি।
বাবুজি, আপনি তো সারাদিনই কাজ করে যাচ্ছেন। একটু চা খাবেন না? মুখ তুলে দেখলাম ম্যানেজার সায়েবের বেয়ারা।
মিষ্টি হাসি দিয়ে সে আমাকে নমস্কার করলে। বয়স হয়েছে ওর! মাথার চুলগুলো সাদা হয়ে এসেছে। কিন্তু পেটা লোহার পাতের মতো চেহারা। ও বললে, আমার নাম মথুরা সিং!
বললাম, মথুরা সিং, তোমার সঙ্গে আলাপ করে খুব খুশি হলাম।
মথুরা সিং বললে, বাবুজি, আপনার জন্য একটু চা নিয়ে আসি।
চা? কোথা থেকে নিয়ে আসবে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
সে আমি নিয়ে আসছি, বাবুজি। আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার সম্বন্ধে এখনও কোনো সিলিপ ইসু হয়নি; অর্ডার হয়ে গেলে তখন আপনার খাওয়াদাওয়ার অসুবিধা হবে না, মথুরা সিং বললে।
আপিস ঘরের মধ্যেই মথুরা চা নিয়ে এল। চা তৈরি করে, কাপটা আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে, মথুরা বললে, শেষ পর্যন্ত বাবুজি, আপনি এখানে এলেন?
মথুরা, তুমি কি আমাকে চিনতে? আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
আপনি তো ব্যারিস্টার সায়েবের বাবু ছিলেন?মথুরা বললে, কলকাতা শহরে ওই সায়েবকে কে চিনত না বাবু? ওঁর বেয়ারা মোহনের বাড়ি আমাদের গ্রামে।
তুমি তা হলে কুমায়ুনের লোক?
হ্যাঁ, হুজুর। মোহনের সঙ্গে দেখা করতে আমি আপনাদের ওখানে অনেকবার গিয়েছি; আপনাকে কয়েকবার আমি দেখেছি।
বড় আনন্দ হল। অপরিচিতের হাটে এতক্ষণে যেন আপনজন খুঁজে পেলাম। বাংলা দেশ যদি আমার মাতৃভূমি হয়, কুমায়ুন আমার দ্বিতীয় মা। কুমায়ুনের প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য আছে, বিখ্যাতদের পদধূলি লাভ করে ইদানীং সে আরও প্রখ্যাত হয়েছে, তাকে ভালোবাসার লোকের অভাব নেই। কিন্তু কুমায়ুন যদি পৃথিবীর জঘন্যতম স্থান হত, ম্যালেরিয়া, আমাশয় এবং ডেঙ্গুজ্বরের ডিপো হত, তা হলেও আমি তাকে ভালোবাসতাম। এই পোড়া দেশে এখনও যে। এমন জায়গা আছে ভাবতে আশ্চর্য লাগে। ওখানে বাড়ির চারিদিকে কেউ পাঁচিল দেয় না, মনের মধ্যে বিভেদের পাঁচিল তুলতেও ওখানকার লোকেরা আজও শেখেনি।
মথুরা বললে, বাবুজি, এই চাকরিতে আপনি এসেছেন, ভালোই হয়েছে। তবে ঘাবড়ে যাবেন না। এমন অনেক কিছুই হয়তো দেখবেন, যা এর আগে কখনও দেখেননি, হয়তো কানেও শোনেননি। কিন্তু ভয় পাবেন না। এই চল্লিশ বছর ধরে আমিও তো কম দেখলাম না। কিন্তু মাথা উঁচু করে এতদিন তো বেঁচে রইলাম। আপনাদের আশীর্বাদে আমার ছেলেটাও চাকরি পেয়েছে।
কোথায়? এই হোটেলে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
মাপ করুন, হুজুর। জেনে শুনে এখানে কেউ নিজের ছেলেকে পাঠায়?
আমি বললাম, মথুরা, নিজের কর্মস্থান সম্বন্ধে সকলেরই একটা অবজ্ঞা থাকে। যাকে জিজ্ঞাসা করো সেই বলবে, আমি নিজে ভুগেছি, ছেলেকে আর ভুগতে দেব না।