নিশ্চয়ই, নিশ্চয়। ডানদিকের ক্যাশ বাক্সটা খুলে, এক টাকার দশখানা নোট বার করে বোস ডাক্তার সায়েবের দিকে এগিয়ে দিলেন। একটা ছাপানো ভাউচার বাঁ হাতে খসখস করে সই করে দিয়ে ভদ্রলোক আবার হোটেলের ভিতর চলে গেলেন।
মেমসায়েব ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন, লোকটি কে?
বোস বললেন, ডক্টর সাদারল্যান্ড। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কাজে এদেশে এসেছেন।
ভদ্রমহিলা এবার একটু অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন, তোমাদেরও মাথা খারাপ। তোমরা তোমাদের এনসিয়েন্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানের উদ্ধারের জন্য কোনো চেষ্টা করছ না। ইউ পিপল, জানো, এইসব ডাক্তাররা—যাদের তোমরা ডেমি গডের মতো খাতির করে বিদেশে থেকে আনছ, যাদের কমফর্টের জন্য তোমাদের কান্ট্রি লাখ লাখ ডলার খরচ করছে—তারা একজন অর্ডিনারি আমেরিকান সিটিজেনকে ঘুম পাড়াতে পারে না। অথচ এই কান্ট্রির নেকেড ফকিররাও ইচ্ছে করলে একশো বছর, দেড়শো বছর একটানা ঘুমিয়ে থাকতে পারে।
উভয় সঙ্কটে পড়ে বোস চুপ করে রইলেন।
ভদ্রমহিলা তখন বললেন, আমি তোমাদের সাদারল্যান্ডে ইন্টারেস্টেড নই; আমি ইন্টারেস্টেড তোমার পিসিমাতে। আমি সেই গ্রেট লেডির সঙ্গে দেখা করতে চাই। প্রয়োজন হলে, আমি চিঠি লিখে এই গ্রেট লেডির টেলিভিশন প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করব। তোমরা জানো না, স্টেটসে তোমার পিসিমার অভিজ্ঞতার কি প্রয়োজন রয়েছে-0. S. A needs her
মিস্টার বোসের চোখ দুটো এবার ছলছল করে উঠল। পকেট থেকে রুমাল বার করে তিনি ঘন ঘন চোখ মুছতে লাগলেন।
ভদ্রমহিলা বিব্রত হয়ে বললেন, কী হল? আমি কি না জেনে তোমাকে কোনো আঘাত দিয়েছি?
চোখ মুছতে মুছতে সত্যসুন্দর বোস বললেন, না, না, তোমার দোষ কী? তুমি কী করে জানবে যে হতভাগ্য আমি মাত্র দু-মাস আগে পিসিমাকে চিরদিনের জন্য হারিয়েছি?
কিছু মনে কোরো না, মিস্টার বোস। আই অ্যাম অফুলি স্যরি। তোমার পিসিমার আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক। বলতে বলতে ভদ্রমহিলা ট্যাক্সির খোঁজে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।
মিস্টার বোসকে হঠাৎ এইভাবে ভেঙে পড়তে দেখে আমিও অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম। কোনোরকমে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, বোসদা, সংসারে কেউ কিন্তু চিরদিন বেঁচে থাকতে পারেন না। আমার বাবা বলতেন, পৃথিবীতে আমাদের সকলকেই একা থাকবার অভ্যাস করতে হবে।
বোসদা এবার হেসে ফেললেন। ওঁকে হাসতে দেখে আমি আরও ভড়কে গেলাম। উনি তখন বললেন, আমার বাবার কোনো বোনই ছিল না। সব বানানো! পিসিমাকে তাড়াতাড়ি না মেরে ফেললে, বুড়ি আমার আরও একটি ঘণ্টা সময় নষ্ট করত। অথচ অনেক কাজ জমা হয়ে রয়েছে।
আমি অবাক।
সত্যসুন্দরবাবুকে বললাম, সেন্ট জন চার্চের কাছে ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটে যে হাইকোর্ট রয়েছে, সেখানে আপনার যাওয়া উচিত ছিল; এই বুদ্ধি ওখানে খাটালে এতদিনে সহজেই গাড়ি বাড়ি করতে পারতেন।
স্যাটা বোস এবার যেন গম্ভীর হয়ে উঠলেন। নিজের মনেই বললেন, গাড়ি বাড়ি? নাঃ থাক, তুমি নতুন মানুষ, এখন সেসব শুনে কাজ নেই।
হয়তো আরো কথা হত, কিন্তু বেয়ারা এসে খবর দিল, ম্যানেজার সায়েব রান্নাঘর ইন্সপেকশনে নিচেয় নেমেছেন।
বোস বললেন, মার্কোপোলো সায়েবের চাদমুখটা একবার দেখে আসুন। ওঁর সঙ্গেই তো আপনার ঘরসংসার করতে হবে।
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, লোক কেমন?
আপনার কেমন মনে হয়? উনি উল্টো প্রশ্ন করলেন।
নামটা রোমান্টিক। এমন নাম যে এখনও চালু আছে জানতাম না।
বোস বললেন, হা, রোমান্টিকই বটে। আসল মার্কোপোলোকে শেষ জীবন জেলে কাটাতে হয়েছিল, ইনি কোথায় শেষ করেন দেখুন।
সে রকম কোনো সম্ভাবনা আছে নাকি? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
না না। এমনি বলছি। খুবই কাজের লোক। পাকা ম্যানেজার। জানেন তো ওমর খৈয়াম কী বলে গিয়েছেন? ভালো প্রধানমন্ত্রী পাওয়া যে-কোনো দেশের পক্ষেই কঠিন ব্যাপার; কিন্তু ভালো হোটেল ম্যানেজার পাওয়া আরও কঠিন। দে আর বর্ন অ্যান্ড নট মেড। অপদার্থ মন্ত্রীর হাত থেকে কোনো কোনো দেশকে রেহাই পেতে দেখা গিয়েছে, কিন্তু অপদার্থ ম্যানেজারের মুঠো থেকে কোনো হোটেলকে আজ পর্যন্ত বেরিয়ে আসতে দেখা যায়নি, বোস হাসতে হাসতে বললেন।
স্যাটা আরও বললেন, ভদ্রলোক রেঙ্গুনের সব চেয়ে বড় হোটেলের ম্যানেজার ছিলেন। এখানকার ডবল মাইনে পেতেন। কিন্তু মাথায় কী এক ভূত চাপল। কলকাতায় কাজ করতে এলেন। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম, হয়তো কোনো গণ্ডগোল বাধিয়ে এসেছেন। কিন্তু ওখানকার স্টুয়ার্ড ফ্রান্সে ফিরে যাবার পথে, আমাদের হোটেলে দুদিন ছিল। সে বললে, রেঙ্গুন হোটেল মার্কোপোলো সায়েবকে এখনও ফিরে যেতে অনুরোধ করছে।
মেঝে কেন পরিষ্কার করা হয়নি? ধাপার মাঠ যে এর থেকে পরিষ্কার থাকে, রান্নাঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ম্যানেজার সায়েব চিৎকার করছিলেন।
দেখলাম, হেড-কুক ও মশালচি ব্যস্ত হয়ে এ-দিক ও-দিক ছোটাছুটি করছে, আর মার্কোপোলো ঘরের সমস্ত কোণ খুঁটিয়ে ময়লা আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন।
আমার পায়ের শব্দ পেয়েই সায়েব মুখ তুললেন।হ্যালো, তুমি তাহলে এসে গিয়েছ?
আমি সুপ্রভাত জানালাম।
কাজকর্ম একটু-আধটু দেখতে আরম্ভ করেছ তো? সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন।
হেড-কুক নিধনযজ্ঞের এবার বোধহয় বিরতি হল। কারণ সায়েব আমাকে নিয়ে আপিস ঘরের উদ্দেশে পাড়ি দিলেন।
আপিস ঘরটা ছোট্ট। মাত্র খান তিনেক চেয়ার আছে। পাশে একটা টাইপরাইটারও রয়েছে। টেবিলে একরাশ কাগজপত্তর। এক কোণে দুটো লোহার আলমারিও দাঁড়িয়ে আছে। ডান দিকের দেওয়ালে আর একটা দরজা, বোধহয় ওইটা খুলে মার্কোপোলো সোজা নিজের বেডরুমে চলে যেতে পারেন।