কার্ডগুলো ডাইনিংরুমে পাঠিয়ে দিয়ে মিস্টার স্যাটা বোস বললেন, অষ্টম হেনরির নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? দাড়িওয়ালা ওই বিশাল মোটা লোকটার ছবি ইতিহাসের বইতে দেখে আমার এমন রাগ হয়েছিল যে, ব্লেড দিয়ে ভদ্রলোককে সোজা কেটে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু তখন কি জানতাম যে, ভদ্রলোক আমাদের এইভাবে ড়ুবিয়ে গিয়েছিলেন; তা হলে শুধু ব্লেড দিয়ে কেটে নয়, ছবিটাকে আগুনে পুড়িয়ে শান্তি পেতাম।
কেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
শুধু বিয়ে করতে নয়, অষ্টম হেনরি খেতেও খুব ভালোবাসতেন, মিঃ বোস বললেন। একবার উনি এক ডিউকের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে অন্য হোমরা-চোমরা যারা খেতে বসেছিলেন, তারা ডিনার টেবিলে একটা আশ্চর্য জিনিস দেখলেন। অষ্টম হেনরি মাঝে মাঝে তার টেবিলে রাখা একটুকরো কাগজের দিকে নজর দিচ্ছেন, তারপর আবার খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। লর্ড, ডেপুটি-লর্ড, কাউন্ট, আর্ল এবং পারিষদরা তো মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। ওটা কী এমন মূল্যবান দলিল যে, হিজ ম্যাজেস্টিকে খাবার মধ্যেও তা পড়তে হচ্ছে? নিশ্চয়ই কোনো গুরুতর টপ-সিক্রেট সংবাদ দূত মারফত সবেমাত্র এসে পৌঁচেছে। খাওয়া শেষ হলে সম্রাট কিন্তু কাগজটা টেবিলের উপর ফেলে রেখেই ডিউকের ড্রইংরুমে চলে গেলেন। সাঙ্গোপাঙ্গরা সবাই তখন টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। কিন্তু হায়! রাজ্যের কোনো গোপন সংবাদ কাগজটাতে নেই—শুধু কতকগুলো খাবারের নাম লেখা। ডিউক ভোজসভার জন্য কী কী খাবারের ব্যবস্থা করেছেন, তা একটা কাগজে লিখে সম্রাটকে দিয়েছিলেন। সবাই তখন বললেন, বাঃ, চমৎকার বুদ্ধি তো। আজে বাজে জিনিসে পেট ভরিয়ে তারপর লোভনীয় কোনো খাদ্য এলে আফসোসের শেষ থাকে না। মেনুর মারফত পূর্বাহ্নে আয়োজনের পূর্বাভাস পেলে, কোনটা খাব, কোনটা খাব না, কোনটা কম খাব, কোনটা বেশি টানব আগে থেকেই ঠিক করে নেওয়া যায়।
মিস্টার বোস একটু হেসে বলতে লাগলেন-সেই থেকেই মেনুকার্ড চালু হল। সম্রাটকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে আমাদের মতো হোটেল কর্মচারীদের সর্বনাশ করা হল। প্রতিদিন শাজাহান হোটেলের ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ এবং ডিনারের মেনুকার্ড টাইপ করো, টেবিলে টেবিলে সাজিয়ে দেবার ব্যবস্থা করো। খাওয়া শেষ হলে কার্ডগুলো টেবিল থেকে তুলে নিয়ে আবার স্টোররুমে পাঠিয়ে দাও। বান্ডিল-বাঁধা অবস্থায় কার্ডগুলো ধুলোর পাহাড়ে বছরখানেক পড়ে থাকবে। তারপর একদিন স্যালভেশন আর্মির লোকদের খবর দেওয়া হবে। তারা লরি করে এসে পুরনো কাগজপত্তর সব নিয়ে ঘরটাকে খালি করে দিয়ে চলে যাবে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সত্যসুন্দরবাবু বললেন, সময়কে এখানে আমরা অন্যভাবে ভাগ করে নিয়েছি, বেড় টি দিয়ে এখানে সময়ের শুরু হয়। তারপর ব্রেকফাস্ট টাইম। বাইরের লোকেরা যাকে দুপুর বলে, আমাদের কাছে সেটা লাঞ্চ টাইম। তারপর আফটারনুন টি টাইম, ডিনার টাইম, এবং সেইখানেই শেষ ভাববেন না। ক্যালেন্ডারের তারিখ পাল্টালেও আমরা পাল্টাই না। সে-সব ক্রমশ বুঝতে পারবেন।
দেখলাম, ব্রেকফাস্টের সময় থেকেই হোটেলের কাউন্টারে কাজ বেড়ে যায়। কথা বলবার সময় থকে না। রাত্রের অতিথিরা নিজেদের সুখশয্যা ছেড়ে লাউঞ্জে এসে বসেছেন। কাউন্টারের পাশ দিয়ে যাবার সময়, যন্ত্রচালিতের মতো সুপ্রভাত বিনিময় হচ্ছে। গেস্টরা কাছাকাছি এসে, কাউন্টারের দিকে এক-একটি গুড মর্নিং ছুড়ে দিচ্ছেন, আর মিস্টার বোস, অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের মতো সেটা লুফে নিয়ে, আবার ফিরিয়ে দিচ্ছেন-গুড মর্নিং মিস্টার ক্রেবার—গুড মর্নিং ম্যাডাম, হ্যাড এ নাইস স্লিপ? রাত্রে ঘুম হয়েছিল তো?
এক বৃদ্ধা আমেরিকান মহিলা কাউন্টারের কাছে এগিয়ে এলেন। ঘুম? মাই ডিয়ার বয়, গত আট বছর ধরে ঘুম কাকে বলে আমি জানি না। প্রথম প্রথম পিল খেয়ে ঘুম হত; তারপর ইনজেকশন নিতাম। এখন তাতেও কিছু হয় না। সেইজন্যই ওরিয়েন্টে এসেছি—ম্যাজিক দিয়ে পুরনো দিনে এদেশে
অসাধ্যসাধন হত, যদি তার কিছুটাও এখন সম্ভব হয়।
মিস্টার বোসকে সহানুভূতি প্রকাশ করতে হল। আহা! পৃথিবীতে এত পাজি দুষ্টু এবং বদমাস লোক থাকতে ঈশ্বর তোমার মতো ভালো মানুষের উপর নির্দয় হচ্ছেন কেন? তবে, তুমি চিন্তা করো না, এ-রোগ সহজেই সেরে যায়।
গভীর হতাশা প্রকাশ করে ভদ্রমহিলা বললেন, এই জন্মে আর ঘুমোতে পারব বলে তো মনে হয় না।
কী যে বলেন। বালাই ষাট। আমার পিসিমারও তো ওই রকম হয়েছিল। কিন্তু তিনি তো ভালো হয়ে গেলেন।
কেমন করে? কী ওষুধ খেয়েছিলেন? ভদ্রমহিলা এবার কাউন্টারের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।
ওষুধ খেয়ে নয়। প্রার্থনা করে—বাই প্রেয়ার। পিসিমার মতে, পেয়ারের মতো শক্তি নেই। প্রেয়ারে তুমি পৰ্বতকে পর্যন্ত নড়াতে পারো।
বৃদ্ধা মহিলা যেন অবাক হয়ে গেলেন। ভ্যানিটি ব্যাগ এবং ক্যামেরাটা কাউন্টারের উপর রেখে মাথায় বাঁধা সিল্কের রুমালটা ঠিক করতে করতে বললেন, তার কি কোনো সুপারন্যাচারাল পাওয়ার আছে?
তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই আর এক ভদ্রলোক কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ছফুট লম্বা, সুদর্শন বিদেশি। কাঠামোখানা যেন ডরম্যান লং কোম্পানির পেটানো ইস্পাত দিয়ে তৈরি। বোস তার দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, গুড মর্নিং ডক্টর।
চশমার ভিতর থেকে তির্যক দৃষ্টি হেনে ডাক্তার শুভেচ্ছার প্রত্যুত্তর দিলেন। তারপর গম্ভীরভাবে বললেন, আমি কি দশটা টাকা পেতে পারি?