০১. ওরা বলে এসপ্ল্যানেড, আমরা বলি চৌরঙ্গী
উৎসর্গ
আমার সাহিত্যজীবনের প্রযোজক, পরিচালক ও সুরকার শ্ৰীশঙ্করীপ্রসাদ বসুকে।
–শংকর
চৌরঙ্গী লেখবার প্রথম অনুপ্রেরণা যাঁর কাছ থেকে পেয়েছিলাম সেই শ্রদ্ধেয় বিদেশি এখন পরলোকে। জীবিত এবং মৃত, দেশি এবং বিদেশি, পরিচিত এবং অপরিচিত অনেকে প্রকাশ্যে এবং নেপথ্যে নানাভাবে সাহায্য করেছেন। তাদের সকলের উদ্দেশে আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার রইল।
–শংকর ১০ জুন, ১৯৬২
Our life is but a winters day : Some only breakfast and away; Others to dinner stay and are full fed; The oldest man but sups and goes to bed; He that goes sounest has the least to pay.
–A. C. Maffen
০১.
ওরা বলে—এসপ্ল্যানেড্। আমরা বলি—চৌরঙ্গী। সেই চৌরঙ্গীরই কার্জন পার্ক। সারাদিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত শরীরটা যখন আর নড়তে চাইছিল না, তখন ওইখানেই আশ্রয় মিলল। ইতিহাসের মহামান্য কার্জন সায়েব বাংলাদেশের অনেক অভিশাপ কুড়িয়েছিলেন। সুজলা-সুফলা এই দেশটাকে কেটে দুভাগ করবার বুদ্ধি যেদিন তার মাথায় এসেছিল, আমাদের দুর্ভাগ্যের ইতিহাস নাকি সেই দিন থেকেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু সে তো অনেক দিন আগেকার কথা। বিশ শতকের এই মধ্যাহ্নে মে মাসের রৌদ্রদগ্ধ কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে আমি ইতিহাসের বহুধিকৃত সেই প্রতিভাদীপ্ত ইংরেজ রাজপুরুষকে প্রণাম করলাম; তার পরলোকগত আত্মার সদ্গতি প্রার্থনা করলাম। আর প্রণাম করলাম রায় হরিরাম গোয়েঙ্কা বাহাদুর কে টি, সি আই ই-কে। তার পায়ের গোড়ায় লেখা-Born June 3, 1862. Died February 28, 1935.
আমাকে মনে আছে কি? অনেক দিন আগে কাসুরে এক অপরিণত-বুদ্ধি বালক বিভূতিদার হাত ধরে রামকেষ্টপুর ঘাট থেকে অম্বা স্টিমারে গঙ্গা পেরিয়ে হাইকোর্ট দেখতে এসেছিল। সায়েব ব্যারিস্টারের কাছে চাকরি পেয়েছিল সে। ছোকাদার স্নেহ পেয়েছিল। জজ, ব্যারিস্টার, মক্কেল সবার ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে সে প্রাণভরে বাবুগিরি করেছিল, আর দুটি বিস্মিত চোখ দিয়ে এক অপরিচিত জগতের রূপ রস গন্ধ উপভোগ করেছিল।
দুঃখ আর দৈন্যের অন্তহীন মরুভূমির মধ্যে বিশ্বপ্রেমিক বিদেশির মরূদ্যানে আশ্রয় পেয়ে, আমার ক্লান্ত প্রাণ অকস্মাৎ অতীতকে ভুলে গিয়েছিল। ভেবেছিল, এ আশ্রয় বুঝি চিরকালের। কিন্তু সংসারের সদা-সতর্ক অডিটররা হিসেবে ভুল ধরার জন্য সর্বদাই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমারও ভুল ধরা পড়তে দেরি হলো না। সায়েব চোখ বুজলেন। মরূদ্যানের তবু আমাদের মতো অভাগাদের কল্যাণে, সামান্য ঝড়েই ধ্বংস হয়ে গেল। আবার চলো। ফরওয়ার্ড মার্চ—বিজয়ী বিধাতার হৃদয়হীন সেনাপতি পরাজিত বন্দিকে হুকুম দিলেন। প্রাণ না চাইলেও, আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত মনটাকে ক্লান্ত দেহের ঠেলাগাড়িতে চড়িয়ে আবার যাত্রা শুরু করতে হলো। Onward! Dont look back-সামনে সামনে। পিছনে তাকিও না।
আমার পিছনে এবং সামনে কেবল পথ। যেন রাত্রের অন্ধকারে ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটের অচেনা সরাইখানায় আশ্রয় পেয়েছিলাম। এখন ভোরের আলোয় পথকে আবার ঘর করেছি। হাইকোর্টের বাবুরা এসেছিলেন। চোখের জল ফেলেছিলেন। ছোকাদা বলেছিলেন, আহা, এই বয়সে স্বামী হারালি! একেবারে কাঁচা বয়েস।
আমি কিন্তু কাদিনি। একটুও কাঁদিনি। বজ্রাঘাতে আমার চোখের সব জল যেন ধোয়া হয়ে গিয়েছিল।
ছোকাদা কাছে ডেকে বসিয়েছিলেন। শিখের দোকান থেকে চা আনিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বুঝি ভাই, সব বুঝি। কিন্তু এই পোড়া পেটটা যে কিছুই বুঝতে চায় না। সামান্য যা হয় কিছু মুখে দে, শরীরে বল পাবি।
ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটে সেই আমার শেষ চা-খাওয়া। ছোকাদা অবশ্য বলেছিলেন, ভাবিস না, এই পাড়াতেই কিছু একটা জুটে যাবে। তোর মতো বাবুকে কোন সায়েবের না রাখতে ইচ্ছে হয় বল? তবে কিনা এক স্ত্রী থাকতে, অন্য কাউকে নেওয়া। সবারই তো বাবু রয়েছে।
জোর করে কথা বলা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু সেদিন চুপ করে থাকতে পারিনি। জোর করেই বলেছিলাম, ছোকাদা, আমি পারব না। চাকরি পেলেও এ-পাড়ায় আর থাকতে পারব না।
ছোকাদা, অর্জুনদা, হারুদা সবাই সেদিন আমার দুঃখে অভিভূত হয়েছিলেন। বিষণ্ণ ছোকাদা বলেছিলেন, আমাদের দ্বারা তো হল না। যদি কেউ পারে তো তুই পারবি। পালিয়ে যা—আমরা জানব এই সর্বনাশা গোলকধাঁধা থেকে অন্তত একজনও বেরিয়ে যেতে পেরেছে।
ওঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, আমিও টিফিন কৌটো সমেত কাপড়ের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। পশ্চিম আকাশের বিষণ্ণ সূর্য সেদিন আমার চোখের সামনেই অস্ত গিয়েছিল।
কিন্তু তারপর? সেদিন কি আমি জানতাম, জীবন এত নির্মম? পৃথিবী এত কঠিন, পৃথিবীর মানুষরা এত হিসেবি?
চাকরি চাই। মানুষের মতো বেঁচে থাকবার জন্যে একটা চাকরি চাই। কিন্তু কোথায় চাকরি?
ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেট হাতে কয়েকজন পরিচিতের সঙ্গে দেখা করেছি। প্রচুর সহানুভূতি দেখিয়েছেন তারা। আমার আকস্মিক ভাগ্যবিপর্যয় তাদের প্রাণে যে কত আঘাত দিয়েছে তাও জানিয়েছেন। কিন্তু চাকরির কথাতেই আঁতকে উঠেছেন। বলেছেন, দিনকাল বড়ই খারাপ। কোম্পানির ফাইনান্সিয়াল অবস্থা হ্যাপি নয়। তবে ভেকান্সি হলে নিশ্চয়ই খবর পাঠাবেন।