—কি বললেন?
মেজবৌদির মুখে এমন অঢেল হাসি দেখেই বুঝেছে সাঙ্ঘাতিক কিছু নয়। তবু উৎকণ্ঠা যায় না।
–বল না, কি বললেন।
মেজবৌদি হাসতে হাসতে বললে, সেই অকালকুষ্ম তোমাকে ঘটকালি করতে পাঠিয়েছে কেন? নিজে এসে বলতে পারে না? আমি বাঘ না ভালুক? আমি তো তার বাবা।
ধ্রুবর মুখেও তখন হাসি ফুটেছে। হাসতে হাসতেই বললে, অসম্ভব। আমি নিজে গিয়ে এখনও বলতে পারব না। কিন্তু রাজি হয়েছেন কি না বলবে তো?
মেজবৌদি বললে, তোমরা মনে কর তোমরাই বেশি চালাক। বাবা কি বললেন জানো? বললেন, ও আমি অনেকদিন থেকেই বুঝতে পেরেছি, শুধু ভাবছিলাম আহাম্মকটা কিছু বলছে না কেন! মেয়েটি শেষ পর্যন্ত রাজি হল না নাকি।
ধ্রুব হেসে ফেলল। বললে, আর মা?
–বাবার মত ছাড়া মার কি আর কোনও মত আছে নাকি? মাও খুশি। সঙ্গে সঙ্গে ধ্রুবর বুক থেকে একটা ভার নেমে গেল। কিন্তু ওর তখন অবাক হবার পালা। সত্যি ভাবতে পারছিল না বাবা এত সহজ ভাবে নেবেন, এত সহজে মত দেবেন।
মেজবৌদি বললে, তার চেয়ে বড় কথা কি জানো? দিদি জিগ্যেস করেছিল, ঠিকুজিটা একবার মিলিয়ে নেবেন না? বাবা উত্তর দিলেন, নিজেরা বিয়ে করছে, সেখানে আবার ঠিকুজিকুষ্ঠি কি হবে? যেখানে আমরা ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়েছি, কেমন ভয়-ভয় করত।
অজানা অচেনা সব, তাই অত ভাবতে হয়। বলে হাসলেন।
ধ্রুব শুনে বললে, আমার কুড়িটা টাকা জলে গেল।
—কেন? মেজবৌদি হেসে তাকাল ধ্রুবর চোখের দিকে। আর ধ্রুব বললে, বাবা যদি রাজিও হন, ঠিকুজি চাইবেন ভেবে জ্যোতিষীকে দিয়ে এমন রাশিচক্র বানিয়ে নিয়েছি প্রীতির, একেবারে রাজযোটক।
মেজবৌদি হাত পেতে বললে, এবার ঘটক বিদেয় কি দেবে দাও। বাবা নিজেই বলেছেন, ঘটকালি করতে তোমাকে পাঠাল কেন।
ধ্রুব বললে, দেব দেব।
তারপর বেরিয়ে গেল। তখনই খবরটা প্রীতিকে দেবার জন্যে। ইচ্ছে করেই সেদিন অনেক রাত করে ফিরেছিল। রাত্তিরে বাবার সঙ্গে, বাবার সামনে যাতে খেতে বসতে না হয়। কি বলে বসবেন, কি জিগ্যেস করবেন সেই ভয়ে।
তারপর বিয়েটা হয়ে গেল। হরিশ মুখাজি রোডের সেই আগের বাড়িতেই। ওই বৌভাতের দিনেই রাখালবাবুকে ভাল করে দেখেছিল। দুএকটা কথাও বোধহয় বলেছিল। তবে তেমন একটা আদর আপ্যায়ন করেনি। কেন করবে। ছোট হলেও পুরো বাড়িটাই ওরা তখন ভাড়া নিয়ে আছে। বাবা সদ্য রিটায়ার করেছেন, কিন্তু তিন ছেলেই চাকরি করে। বেশ সচ্ছল।
আর রাখালবাবু থাকতেন ওদের সামনের বাড়ির একতলার একখানা কি দেড়খানা ঘর নিয়ে। স্ত্রী ও দুতিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। দেখে মনে হত বেশ দুঃস্থ।
হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িটার সামনেই রাস্তার ওপারে তখন ছিল টানা ব্যারাকের মতো দোতলা একটি বিধ্বস্ত বাড়ি। তার খোপে খোপে অনেকগুলি ভাড়াটে পরিবার। তারই একটিতে থাকত রাখালবাবুর সংসার। পলেস্তারা খসে খসে দেয়ালের ইট বেরিয়ে পড়েছে, জানালা দরজার কি রঙ ছিল বোঝাই যায় না, জানালা বন্ধ করার সময় সারা পাড়ার লোক শুনতে পেত। বাড়ির মালিক হেমন্তবাবু থাকতেন দোতলায়। বিরাট সংসার, এবং শেষের দিকে তাঁকে দেখেও বেশ দুঃস্থ মনে হত। ঘরে চল্লিশ পাওয়ারের টিমটিমে বা জ্বলতো, তাও দুখানি কি একখানি ঘরে।
কিন্তু হেমন্তবাবু মানুষটি ছিলেন খুব সজ্জন। যৌবনে তাঁর হয়তো একটু সৌন্দর্য পিপাসাও ছিল। বাড়ির এককোণে একটা পলাশ গাছ যখন লাল হয়ে কত, দেখতে ভালই লাগত ধ্রুবর। দেয়াল বেয়ে ওঠা বোগেনভেলিয়া বয়েসের বলিষ্ঠতায় আর লতা ছিল না, প্রায় কাণ্ড। ফুলে ছাওয়া। পিছনের দিকে খালি জমিতেও ঘাসঝোপের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটা গাছ নিতান্ত অযত্নেও ফুল ফোটাত। সেটা তখন আর বাগান ছিল না, বেশির ভাগ সময়েই সেখানে নীচের ভাড়াটেরা কাপড় শুকোতে দিত। কাপড় শুকোনোর জায়গা নিয়ে, কিংবা কাপড় টাঙানোর দড়ি ছেড়া নিয়ে ভাড়াটেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটিও শোনা যেত।
এই ভাড়াটেদেরই একজন রাখালবাবু। রাস্তায় যেতে আসতে কদাচিৎ দেখা হত। সুমিতা কিংবা বড়বৌদির কাছে খুব শুনেছিল ভদ্রলোক কিসের যেন ব্যবসা করেন। খুব ভেবেছিল, দোকানটোকান আছে হয়তো। ওঁর সম্পর্কে ধ্রুবর কোনও ঔৎসুক্যও ছিল না। বৌভাতের দিনে যা দুচারটে কথা।
তারপর হঠাৎ একদিন রাস্তায় দেখা হতেই রাখালবাবু ডেকে বসলেন।–এই যে ধ্রুব, তোমার সঙ্গে একট কথা ছিল।
ধ্রুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাঁড়িয়ে পড়ল। মুখে হাসি আনল।
—তোমার বড়দার কাছেই আমি গেসলাম, বড়দা বললেন, বুঝলে কি না, তুমি ভাল ইংরিজি জানো, তুমিই ভাল পারবে।
ধ্রুব রাখালবাবুকে এড়িয়ে চলে আসার জন্যে তখন ব্যর্থ। সদ্য অফিস থেকে ফিরছে, এমনিতেই ক্লান্ত। তাছাড়া তখন তো বিয়ের পরের দিনগুলো, প্রীতির কাছে ফিরে আসার জন্যেও বেশ একটা ব্যগ্রতা ছিল।
রাখালবাবু হাসতে হাসতে বললেন, আমি মুখুসুখ মানুষ, সেজন্যেই তোমাদের কাছে ধনা দেওয়া। তোমরা না করে দিলে কার কাছে যাই বল?
ওঁর বলার ধরনে ধ্রুব একটু নরম হল। —কি বলুন?
—আমাদের গাঁয়ে একটা ইস্কুল আছে, বুঝলে কি না। সেখানে একজন উপমন্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বুঝলে কি না। তাঁর নামে ইংরিজিতে একটা অভিনন্দন লিখে দিতে হবে। সরকারি গ্র্যান্ট না বাড়ালে ইস্কুলটা উঠে যাবে।
ধ্রুবর একটুও ইচ্ছে ছিল না। সারা শরীর চিড়বিড় করে উঠেছে। রাগ গিয়ে পড়েছে দাদার ওপর। নিজে কাঁধ থেকে দায়িত্ব নামাবার জন্যে কি দরকার ছিল ধ্রুবর নাম করার। ধ্রুবই ভাল পারবে! কেন? তুমি নিজে করে দিতে পারতে না কিংবা বলতে পারতে না, অন্য কাউকে বলুন!