মেজবৌদি হেসে ফেলে বলেছিল, না ভাই, বিয়ে যখন হয়ে গেছে এখন আর বয়েস কমাব কোনও দুঃখে।
আসলে এ বাড়ির তুলনায় মেজবৌদি ছিল রীতিমত মডার্ন। ওর মুখে নাকি ঠাকুরপো, ঠাকুরঝি ধরনের কথা আসত না, বলতে গেলেই হেসে ফেলত। সেইজন্যেই ধ্রুবদা।
মেজবৌদির সঙ্গেই খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুত্ব হয়েছিল বলেই তার কাছে ধরাও পড়ে গিয়েছিল ধ্রুব।
বিয়ের পর সকলের সামনে সেই সব দিনের কথা ফাঁস করে দিয়ে বলেছিল, ধন্য বাবা তোমরা দুজন। কি নাটকই করলে। আমি ভাবতাম একসঙ্গে পড়ে, আজকাল তো সব বন্ধু বন্ধু, হয়তো তাই।
একঘর লোক, সবাই হাসছিল। সে-সব উচ্ছল আনন্দের দিন। ধ্রুবর মেজদাও ছিল। লজ্জা পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। সুমিতা টিপ্পনি কেটেছিল, ছোটবৌদি কি ধূর্ত বাবা, কেউ টেরও পায়নি। মেজেবৌদি তখন খুশিতে হাসছে। তাই তো বলছি, দুজনে, টেবিলে ঝুঁকে পড়েছে বইয়ের ওপর, ফিসফিস করে কথা বলছে, দেখে আমি ভাবতাম, দুজনের কি পড়ায় মন। ভিতরে ভিতরে যে এত চলছে…
প্রতি অবশ্য প্রতিবাদ করেছে, এই না, সত্যি বলছি মেজবৌদি, তখন সত্যি পড়তাম।
—ছাই পড়তে। তারপর হেসে উঠে বলেছে, ওকে বই পড়া বলে না, প্রেমে পড়া বলে।
সকলে হো হো করে হেসে উঠেছে।
তবে ধ্রুব জানে, মেজবৌদি না থাকলে ব্যাপারটা এত সহজে হত না। বাবা মাকে বলতে সাহসই পেত না ও।
ও তো ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছে, বাবা-মা যাবতীয় ধ্যান-ধারণায় কত গোঁড়া। বাবার হাতে তো সব সময় পাঁজি ঘুরছে। কালবেলা বারবেলা না দেখে কারও কোথাও যাওয়া চলবে না। মা তার চেয়েও বেশি।
মেজদার বিয়ে তো প্রায় ভেঙে যায়। ঠিকুজিকুষ্ঠির মিল হচ্ছিল না। অথচ মেজবৌদিকে দেখে মেজদার দারুণ পছন্দ হয়ে গেছে।
শেষে নতুন একজন জ্যোতিষীকে শিখিয়ে পড়িয়ে ডেকে আনা হয়েছিল। ধ্রুবই সে-সব ব্যবস্থা করেছিল।
ধ্রুব তাই বলেছিল, তোমার একটু কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত। আমি ব্যবস্থা করে কুষ্ঠি না মিলিয়ে দিলে তোমার বিয়ে হত না।
মেজবৌদি জবাব দিয়েছে, আজ্ঞে না। হয়তো আরো ভাল বিয়ে হত। কৃতজ্ঞ থাকতে হয় তো তোমার মেজদার। আমাকে দেখে তারই মাথা ঘুরে গিয়েছিল।
ধ্রুব হেসে বলেছে, সে তোমরা দুজনে বুঝবে কার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু প্রীতিকে বিয়ে করতে চাই একথা বাবা-মাকে তোমাদেরই বলতে হবে। আমি বলতে গেলেই হয়তো পাঁজি ছুড়ে মারবেন।
মেজবৌদি হেসে ফেলেছে। তারপর হাসি থামিয়ে বলেছে, দেখি কি করা যায়। বাবাকে রীতিমত ভয় পেত ধ্রুব। ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছে। গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, ঠাকুরদেবতায় ভক্তি, সব সময় নীতিনিয়ম মেনে চলেন। বাড়িতে নিজেদের মধ্যে একটু হাসিহুল্লোড় হলে ধমক দিতেন।
ধ্রুব জানত, প্রীতিকে ও বিয়ে করতে চায় এ-খবর শুনলেই এ বাড়িতে একটা বিস্ফোরণ ঘটবে। সেজন্যেই বলতে পারছিল না।
প্রীতি যেদিন ধ্রুবর খোঁজে প্রথম এসেছিল, হাতে একরাশ বই খাতা নিয়ে, সেইদিনই রাত্রে খেতে বসে বাবা গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করেছিলেন, মেয়েটি কে? আজ তোর খোঁজে এসেছিল?
তখন তো প্রীতি-সম্পর্কে কোনও দুর্বলতা ছিল না। দিব্যি বলতে পেরেছিল, আমাদের সঙ্গে পড়ে। অসুখ হয়ে পড়েছিল, তাই নোট নিতে পারেনি। খাতাটা নিতে এসেছিল।
–হুঁ।
ব্যস, আর কোনও কথা বলেননি।
ধ্রুবর পক্ষে ওইটুকুই যথেষ্ট। ও বেশ বুঝতে পেরেছিল, ওর এবাড়িতে আসা, ধ্রুবর খোঁজ নেওয়া, বাবার পছন্দ নয়। মনে মনে সেজন্যে বাবার ওপর রেগেও গিয়েছিল। এইসব পুরোনো দিনের লোেকদের নিয়ে মহা সমস্যা। ছেলেমেয়ে একসঙ্গে দেখলেই এরা প্রেম ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। অথচ তখন তো প্রীতির সঙ্গে ভালবাসাবাসি শুরু হয়নি। একসঙ্গে পড়ত, কাছাকাছি থাকত বলেই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এসে হাজির হত। অথচ ধ্রুব তাকে নিষেধও করতে পারত না। নিষেধ করলেই তো প্রীতি হেসে উঠত, বন্ধুবান্ধবদের কাছে গল্প করে বলত, আর সকলের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ত যে ধ্রুবরা ভীষণ ব্যাকডেটেড। প্রাচীনপন্থী। সে এক লজ্জা।
কিন্তু তারপর হঠাৎ কি ভাবে যেন মেজবৌদির সঙ্গে, সুমিতার সঙ্গে প্রীতির বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত কিন্তু ধরা পড়ে গেল মেজবৌদির কাছে। অথচ প্রীতি তখন খুব কমই আসত।
পরীক্ষাটরিক্ষা হয়ে গেল, দুজনেই পাশও করে গেল। আর ধ্রুব খুব সহজেই একটা চাকরি পেয়ে গেল। সামান্য চাকরি, কিন্তু ভাগ্যক্রমে একটা লিষ্ট পেয়ে গেল বছর খানেকের মধ্যেই।
মেজবৌদি বললে, ঠিক আছে আমিই বলব। প্রতিদিন মেজবৌদি স্তোক দেয়, আজই বলব।
আব ধ্রুব অফিস থেকে ভয়ে-ভয়ে ফেরে, বেশ রাত করে। না জানি ফিরেই কি শুনতে হবে।
এসেই মেজবৌদিকে প্রশ্ন করে, বলেছিলে? কিংবা কোনওদিন প্রশ্নও করতে হয় না। ওর চোখের দৃষ্টিই বলে দেয় প্রশ্নটা কি।
মেজবৌদি ঠোঁট উল্টে ইশারায় জানিয়ে দেয়, না, বলতে পারিনি। আসলে মেজবৌদিও ভয় পাচ্ছিল।
তারপর একদিন মেজবৌদি ওর ঘরে এসে হাজির। মুখে উচ্ছল হাসি। উচ্চকিত স্বরে বলে উঠল, এই ধ্রুবদা, আমরা বাবাকে এতদিন একটুও বুঝতে পারিনি। একেবারে অন্য মানুষ, তোমরা কেউ ওঁকে চেনোই না।
ধ্রুবর মনে তখন উদ্বেগ আর কৌতূহল। ব্যাপারটা কি তাই বল।
–সে কথাই তো বলছি। বাবার গম্ভীর মুখটাই এতকাল দেখে এসেছ। ভিতরে কি আছে জানতে চাওনি।
ধ্রুব অধৈর্য হয়ে উঠল, আঃ, বলই না কি বললেন।
মেজবৌদিকে হেসে হেসে বললে, অনেক ধানাইপানাই করে তুললাম কথাটা। প্রীতিকে তোত আপনি দেখেছেন…। মেজবৌদি আবার হেসে উঠল।-বাবা সব শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর; আমার তো বুক ধড়ফড় করছে। হঠাৎ বাবা কি বললেন জানো, শুনলে অবাক হয়ে যাবে।