কিন্তু এখন অন্যরকম। বাড়িভাড়া কথাটাই মিথ্যে হয়ে গেছে। বাড়ি কোথায়, দুএক ঘরের ফ্ল্যাট যদি বা পাওয়া যায়, মাসমাইনের অর্ধেকটাই দিয়ে দিতে হবে। তার ওপর মোটা টাকা অ্যাডভান্স। কোত্থেকে পাবে সে-চিন্তা আমার নয়, দেবার লোক আছে। তাও কাছেপিঠে পাবে না, সরে যেতে হবে শহরের শেষপ্রান্তে। ফ্ল্যাটটাও মনঃপূত হবে না।
তা হলে ভদ্রলোক কি করে ঘণ্টাকয়েকের মধ্যে ব্যবস্থা করে ফেললেন? হয়তো পাঁচজন আত্মীয়ের বাড়িতে ছড়িয়ে রেখেছেন। পরে নিয়ে যাবেন। কিন্তু নিজেরা? সেটা অবশ্য দুপাঁচদিনের জন্যে সমস্যা নাও হতে পারে।
বুকের ওপর থেকে গুরুভার নেমে যেতেই বেশ হাল্কা মনে বাড়ি ফিরল ধ্রুব।
দরজার বাইরে থেকেই বেশ খুশি খুশি অনেকগুলি কণ্ঠে হইহল্লা শুনতে পাচ্ছিল। নিজেদের ফ্ল্যাটে, নাকি ওপাশের ফ্ল্যাট থেকে, বুঝতে পারেনি।
না, নিজেদের ফ্ল্যাটেই। দরজাটাও খোলা, তাই অনেকগুলো চটি দেখতে পেল। মেয়েদের স্লিপার।
প্রীতি ফ্রিজ থেকে কি বের করছিল, ধ্রুবকে দেখতে পেয়েই হাসি হাসি মুখে বললে, কে এসেছে দেখবে এসো। ঢুকেই অবাক। ছোটপিসিমা আর দুই পিসতুতো বোন। রুনি আর সুমি।
প্রীতির এত খুশি হওয়ার কারণ ছোটপিসিমা বড় একটা ধ্রুবদের বাড়িতে আসে না। ওদের অবস্থা খুবই ভাল। পিসেমশাই বড় চাকরি করেন। সেজন্যে ধ্রুবর হয়তো নিজেকে ও বাড়িতে নগণ্য মনে হত। ওরা আসে না বলে ধ্রুবও যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। যায়, ওই একবার বিজয়ার পর। ব্যস।
রুমি বড়, এর মধ্যে আরো বড় হয়ে গেছে। দেখতেও বেশ সুন্দর হয়েছে। শুনেছিল গতবার এম-এ পাশ করে গেছে। ধ্রুব ওদের হাতের দিকে তাকাল, রুমিব বিয়ে নাকি! কই, নিমন্ত্রণের চিঠিফিটি তো নেই।
অথচ সবারই মুখে হাসি উপছে পড়ছে।
পিসিমা হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এসে ধ্রুবর হাতখানা ধরে বললে, কি রে, সব সম্পর্কটম্পর্ক ছেড়ে দিলি নাকি? একবারও যাস না।
ধ্রুবকেও হাসতে হল। সময় কই বল, তার ওপর বাসট্রামে যা ভিড়।
বাসট্রামে ভিড়ের জন্যেই মানুষে মানুষে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, না সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাওয়ার একটা ভাল অজুহাত এই বাসট্রামের ভিড়, সেই মুহূর্তে বুঝতে পারল না ও।
সুমি ছোট, কিন্তু কথার খৈ ফোটে ওর মুখে। বলে বসল, ট্রামবাসে ভিড় বলে যাও, না? তা ধ্রুবদা, একটা ফোন করে দিলেই পারো, গাড়ি পাঠিয়ে দেব।
এতক্ষণে ধ্রুবর মনে পড়ল, বাড়ির সামনে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটা চিনতে পারেনি, হয়তো ড্রাইভার বদলে গেছে বলে। তাছাড়া, ওর মনেও হয়নি গাড়ি করে কেউ ওর কাছে আসতে পারে। ভেবেছিল অন্য কোনও বাড়িতে কেউ এসেছে।
সুমির কথা শুনে ধ্রুব ভিতরে ভিতরে একটু অপ্রসন্ন হলেও মুখে হাসি আনল। গাড়ি যখন আছে, তখন তোরা এলেই তো পারিস।
পিসিমা তখনও হাত ছাড়েনি ধ্রুবর। হাসতে হাসতে বললে, ভাইবোনের ঝগড়া এখন রাখ। যোধপুর পার্কে ফ্ল্যাট কিনেছি। এই মঙ্গলবার গৃহপ্রবেশ। তোরা যাবি কিন্তু।
এই ব্যাপার! এর জন্যেই এত উচ্ছল হাসি আনন্দ।
ধ্রুবরও কিন্তু শুনতে বেশ ভাল লাগল। আত্মীয়স্বজন কি খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব, কেউ বাড়ি করলে কিংবা ফ্ল্যাট কিনলে এক ধরনের আনন্দও হয়। কেমন একটা আশা জাগে, তা হলে আমিও হয়তো পারব।
ধ্রুব খুশি-খুশি মুখেই বললে, দারুণ খবর। তা হলে ভাড়াটে নাম ঘুচল, কি বলিস সুমি!
তারপরই বললে, আমরা তো ভেবেছিলাম, বাড়ি করবে! ফ্ল্যাট কেন?
সঙ্গে সঙ্গে বললে, তবে আমি তো আজকাল পাওয়াই যায় না। বোধহয় সান্ত্বনা দিতে চাইলে।
পিসিমা বললে, প্রীতি বলছিল, তোরাও একটা কিছু করার কথা ভাবছিস। করে ফেল এখনই।
প্রীতির মুখে তখনও হাসি। এগিয়ে এসে পিসিমাকে বলল, ওকে বলুন না সেই জমির কথা।
পিসিমা বললে, শোন ধ্রুব, যাস একদিন। জমিই হোক ফ্ল্যাটই হোক, যদি চাস, তোর পিসেমশাইয়ের কাছে অনেক খবর পাবি।
বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে ধ্রুবর পিসিমারা চলে গেল।
প্রীতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।–এবার আমাদেরও একটা কিছু করে নিতে হবে।
ধ্রুব কোনও জবাব দিল না।
০২. মানুষের উপকার করলে
মানুষের উপকার করলে কখনো-সখনো বড় কাজে লেগে যায়।
বকুলবাগানের এই ফ্ল্যাটখানা পাওয়ার পর ধ্রুবর একথাই মনে হয়েছিল। অথচ কারও উপকার করার কথা ও ভাবেনি।
প্রীতি আর অপেক্ষা করতে রাজি ছিল না। বিশেষ করে ধ্রুবর চাকরিতে একটা ছোটখাটো লিফট হওয়ার পর। ধ্রুব নিজেও আর অপেক্ষা করতে চায়নি।
হরিশ মুখার্জি রোডের যে ভাড়া বাড়িটায় ওরা থাকত, একখানা দোতলা, ছোট বাড়ি, সেখানে ঘরে সংখ্যা ছিল কম। ধ্রুবর বাবা মা এখনও সে বাড়িতেই। ওর দাদা-বৌদিরা সেখানেই। শুধু ধ্রুবকে সরে আসতে হয়েছে। ধ্রুব জানত, সরে আসতে হবে।
প্রীতি ওদের বাড়িতে নিতান্ত অপরিচিত ছিল না। কয়েকবারই গিয়েছে। নানা অজুহাতে।
ধ্রুবর মেজবৌদি রীতিমত বুদ্ধিমতী। দুদিনেই ধরে ফেলেছিল। হাসতে হাসতে বললে, আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। যখন ঠিকই করে ফেলেছ ধ্রুবদা, বাবা-মাকে বলতে এত ভয় কিসের?
মেজবৌদি বয়সে ধ্রুবর চেয়ে সত্যি ছোট কি না বোঝা দায়। সেইজন্যেই হয়তো প্রথম থেকেই মেজবৌদি ওকে ধ্রুবদা বলত।
ধ্রুবর বোন সুমিতা ঠাট্টা করে বলেছিল, সে কি গো বৌদি, ঠাকুরপো বলতে পারো না? ধ্রুবদা আবার কি!
তখন মেজবৌদি তো নতুন বৌ, সদ্য বিয়ে হয়েছে। ধ্রুব হেসে বলেছিল, বুঝতে পারছিস না, বয়েস কমানোর তাল।