—এই যে বাড়িওয়ালা! শোনো শোনো তোমাদের কির্তি।
সুনন্দকে যেতে দেখে অবিনাশ হাঁক দিল।
সুনন্দই বোধহয় প্রথম অবিনাশকে জমিদার আখ্যা দিয়েছিল, কারণ দেশে ওর কিছু জমিজমা আছে। তার পাল্টা জবাবে অবিনাশ ওকে বাড়িওয়ালা বলে ডাকে। কারণ সুনন্দর পৈতৃকসূত্রে পাওয়া একটা বাড়ি আছে।
বেশ ভাল বাড়ি, তিনতলা। আমহার্স্ট স্ট্রিটের ওপর।
বাড়িওয়ালা বললে সুনন্দ প্রথম প্রথম ক্ষুণ্ণ হত। ওটা নিশ্চয় কোনও সম্মানজনক পরিচয় নয়।
একদিন রেগে গিয়ে বলেছিল, কি বাড়িওয়ালা বাড়িওয়ালা করেন।
পরক্ষণেই রেগে যাওয়াটা অশোভন মনে হওয়ায় ইয়ার্কির ঢঙে বলেছিল, যদি বলতেই হয়, ল্যান্ডলর্ড বলুন, আপত্তি করব না।
অবিনাশ চোখ কপালে তুলে বলেছে, আরে ব্বাস, ল্যান্ডলর্ড! লর্ড বলতে হবে।
সুনন্দ তখনই চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়েছে অবিনাশের কাছে। তারপর সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলেছে। অবিনাশদা, বাড়ি একটা আমার আছে ঠিকই, কিন্তু আমার অধিকারে মাত্র দুখানা ঘর, তিনতলায়। শরিকি ঝামেলা বিস্তর, বেচে দেব তার উপায়ও নেই, তার ওপর ভাড়াটেদের অত্যাচার।
অবিনাশ হেসে ফেলেছে। -তাই নাকি? ভাড়াটেরাও অত্যাচার করে? সুনন্দ বোঝাবার চেষ্টা করেছে, অত্যাচারের বিবরণ দিয়েছে। বলেছে, বাবা সেই কোনকালে ভাড়াটে বসিয়ে দিয়ে গেছে, কত ভাড়া পাই জানেন?
সব শুনে মুখে বিষণ্ণ ভাব এনেছে অবিনাশ, কিন্তু ওর দুঃখ-বেদনা কিংবা আরেকখানা ঘরের অভাব, এসবের কিছুই অবিনাশকে স্পর্শ করেনি।
বলেছে দ্যাখো ভাই, তোমার অনেক দুঃখ মানছি, কিন্তু তোমার ভাড়াটেদের দুঃখ আরো বেশি। এই যেমন তুমি তাদের ভাড়াটে বল।
অবিনাশের আশেপাশে যারা ছিল, তারা শব্দ করে হেসে উঠেছে। কিন্তু আঘাত দেবার জন্যে বলেনি অবিনাশ। ও তাই সঙ্গে সঙ্গে বলেছে, এই যেমন দেখ, আমার জমিজমা চলে গেছে, গভর্নমেন্ট নিয়ে নিয়েছে, তার জন্যে আমারও খুব দুঃখ। কিন্তু যাদের জমি নেই, পরের জমিতে চাষবাস করে, তাদের চেয়ে বেশি দুঃখ তো নয়।
সেই সুনন্দকে অবিনাশ আজ আর ডাকল বাড়িওয়ালা বলে। এখন আর বাড়িওয়ালা বললে সুনন্দ চটে না। ও বুঝে নিয়েছে, এটা অবিনাশের নিদোষ ঠাট্টা। তাছাড়া এ অফিসে এই এতগুলো ভাড়াটের মধ্যে একা সুনন্দরই বাড়ি আছে, সে পরিচয়টা খারাপ কিসে! বাড়ি মালিক হওয়ার মধ্যেও তো বেশ একটা গর্ব আছে।
তাই ডাক শুনে হাসতে হাসতে এসে বসল সুনন্দ।
আর ধ্রুব সকালে যা যা দেখেছে বলে গেল। যতখানি দয়া মায়া এবং সমবেদনা সেই অচেনা অজানা ভদ্রলোকের জন্যে ঢেলে দেওয়া সম্ভব, কথার মধ্যে তা মিশিয়ে দিয়ে। তাঁর স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ের বিষণ্ণ লজ্জিত মুখের বর্ণনা দিল। এবং শেষে বললে, যাই বল সুনন্দ, এটা একটা ইনহিউম্যান ব্যাপার।
সুনন্দর মুখ দেখে বোঝা গেল ও খুব আহত হয়েছে। যেন ধ্রুব বলছে, সুনন্দ, তুমিও একটা অমানুষ। হয়তো সত্যি তাই।
সুনন্দ প্রতিবাদ করল।–দেশে আইন আছে, কোর্টকাছারি আছে। লোকটার নিশ্চয় গলদ কিছু ছিল…
অবিনাশ হাসতে হাসতে সুনন্দর উরুর ওপর একটা থাপ্পড় বসাল। বললে, সেটাই তো জানতে চাইছি। তুমি তো ভাই একজন ল্যান্ডলর্ড, অন্ধিসন্ধি তোমারই জানার কথা। কোনও প্যাঁচে তাকে ওঠাল বল তো, আমরা তা হলে সাবধান হতে পারি।
সুনন্দ কোনও কথাই বলেনি, উঠে চলে গিয়েছিল। বেশ বোঝা গিয়েছিল ও রেগে গেছে।
ও চলে যাওয়ার পর ধ্রুব আর অবিনাশ দুজনেরই অনুশোচনা হল। এভাবে সুনন্দকে আঘাত দেওয়া ঠিক নয়। অথচ আঘাত তো দিল। কিন্তু কেন? ঈর্ষা? সুনন্দর একটা বাড়ি আছে বলে কি ওদের মনে কোনও ঈর্ষা আছে? কই, কখনও তো মনে হয়নি। সুনন্দর সঙ্গে এতদিনের বন্ধুত্ব, পাশাপাশি টেবিলে বসে কাজ করে, একজনের বিপদে আরেকজন এসে দাঁড়িয়েছে কতদিন, অথচ তাকেই ওরা ভাবল বিপরীত দিকের মানুষ। কি আশ্চর্য, একজন অজ্ঞাতকুলশীল, কেমন ধরনের লোক কে জানে, ধ্রুব তাকে কোনওদিন দেখেওনি, চেনে না, জানে না, সেই নোকটাই ওদের সমবেদনা পেল। মনে হল আপনজন, আত্মীয়! শুধু সেও একজন ভাড়াটে বলেই?
বাড়ি ফেরাব পথে ধ্রুবর মনে আবার উদ্বেগ ফিরে এল।
প্রীতি একসময় প্রায়ই বাড়ি করার কথা বলত। মাথা গোঁজার মতো একটা আশ্রয়। কিন্তু ধ্রুবর তখন বিষয়আশয়ের দিকে মন ছিল না। কিংবা ওর তেমন বিষয়বুদ্ধিই ছিল না। না, ওসব নিতান্তই অজুহাত। বাড়ি করার মতো টাকাই ছিল না ওর।
এখনও নেই। তবু একটা আশ্রয়ের কথা ভাবতে হচ্ছে। দিনরাত অশান্তি নিয়ে বাস করা যায় না।
ফেরার পথে ধ্রুব সেই রাস্তাটা দিয়েই এল। এখনও সব আসবাবপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কিনা দেখে আসবে। ওগুলো যেন ওর বুকের ওপরই চেপে বসে আছে।
নাঃ, সব সরে গেছে, রাস্তাটা পরিষ্কার। কোথাও কিছু পড়ে নেই। কখন নিয়ে গেছে কে জানে, কোথায় গেছে তাই বা কে বলবে।
ওর বুকের ওপর থেকে একটা গুরুভার যেন নেমে গেল। তা হলে একটা কিছু ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু কি ব্যবস্থা। ধ্রুব ভেবেই পেল না। আজকাল তো আগেকার দিনের মতো বাড়িতে বাড়িতে টু লেট ঝোলে না।
দাদুর কাছে ধ্রুব শুনেছে ওঁদের সময়ে নাকি বাড়িওয়ালারাই ভাড়াটে পেলে ধন্য হয়ে যেত। নিয়মিত ভাড়া পেলে তো কথাই নেই। বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটের মধ্যে কোনও ঈষা-দ্বন্দ্ব-দ্বেষ ছিল না। দুয়ে মিলে যেন একই সংসার। একজনের বিপদ মানে অপরেরও। তখন পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ছিল না, শত্রু ছিল বাইরে। চোর, গুণ্ডা, মাতাল।