অবিনাশ হাসল।—আরে বৌ কাছে থাকলে মাঝে মাঝে মন খারাপ হবে না তাও কি হয়?
একটু থেমে বললে, আমি তো ভাই মাঝে মাঝেই বৌকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিই, বৌয়েরও মন ভাল থাকে, আমারও মন ভাল থাকে। নো খিটিমিটি, নো ঝগড়া।
ধ্রুব হেসে ফেলল। ও জানে অবিনাশ এই রকমই। বয়সে ধ্রুবর চেয়ে দুবছরের বড় হলেও হতে পারে, কিন্তু সব দিক থেকে মানুষটা হাফ সেঞ্চুরি পেছিয়ে আছে। চেহারায়, পোশাক পরিচ্ছদে, কথা বলার ধরনে। আবার গুণগুলোতেও। হাফ সেঞ্চুরি আগেকার মানুষের মতোই খোলামেলা মন, কোথায় একটা আন্তরিকতা আছে। বিপদের সময় এগিয়ে আসে, সান্ত্বনা দেয়। ওর সঙ্গে কি করে যে এত বন্ধুত্ব হল ধ্রুব খুঁজে পায় না। ধ্রুব তো পোশাক আশাকের ব্যাপারে রীতিমতো খুঁতখুঁতে। শার্টের কিংবা ট্রাউজারের ক্রিজ নষ্ট হল কিনা তা নিয়ে সদাই সচেতন।
প্রীতির কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। কি নিয়ে যেন ঝগড়াটা শুরু, ঝাঁঝের গলায় বলেছিল, তোমার শার্ট প্যান্টে ইস্ত্রি ঠেলে ঠেলে হাতের কজি তো খসে গেল।
কথাটা মিথ্যে নয়। ধ্রুব সত্যি একটু ঝকঝকে থাকতে ভালবাসে।
অফিসে এসে হাসতে হাসতে অবিনাশকে সে প্রসঙ্গ বলতেই অবিনাশ ধীরেসুস্থে কৌটো থেকে সুগন্ধি সুপুরি বের করে মুখে পুরে বলেছিল, জবাব দিলে না?
ধ্রুব হেসে বললে, কি জবাব দেব?
অবিনাশ হাসল।–বলতে হত, ম্যাডাম, পোশাক আশাক কি আর নিজের জন্যে? ওসবে আমার কি দরকার। তবে কিনা তোমার স্বামী বলে তো পরিচয় দিতে হবে।
ক্যান্টিনে আরো কে কে যেন ছিল, শব্দ করে হেসে উঠেছিল।
এই হল অবিনাশ।
সকালের দৃশ্যটার কথা বললে ও হয়তো তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে। কিন্তু না বলেও উপায় নেই। মনের মধ্যে একটা উদ্বেগ, একটা দুভাবনা। কোনও একজনকে তো বলতে হবে। বলে হাল্কা হতে হবে। ভেবেছিল প্রীতিকে বলবে, কিন্তু সে তো বলার সুযোগই দিল না। কাপড়ে কতখানি সাবানের গুঁড়ো দিতে হবে, থালায় কেন ছাই লেগে আছে, আর বালতিতে জল ভরা নিয়েই ব্যস্ত। ঠিকে ঝি কিংবা রান্নার লোকের সঙ্গে, সেই ফাঁকে, গল্প জুড়ে দেয়। শুধু ধ্রুবর সঙ্গে কথা বলার সময় নেই। সকালের প্রীতি আর সন্ধের প্রীতি যেন দুটো পৃথক মানুষ।
শেষ অবধি অবিনাশকেই বলল। আসলে ও জানতে চায়, কিভাবে এটা সম্ভব হল। ও তো শুনে আসছে, আজকাল ভাড়াটেকে খোলা যায় না। তবে? আইনের নিশ্চয় কোনও ফাঁকফোকর আছে, সেটাই জানতে চায়। ও নিজেও না কোনওদিন আইনের সেই ক্ষুরস্য ধারায় পড়ে যায়।
অবিনাশের কাছে দৃশ্যটা বর্ণনা করে বলতে অবিনাশ বলে উঠল, ইস!
বেশ যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠল ওর চোখেমুখে।
ধ্রুব তো লোকটিকে চেনেও না, দেখেনি কোনওদিন। তবু দৃশ্যটা দেখেছে। অবিনাশ সেটুকুও দেখেনি। তবু মনে হল ও যেন প্রচণ্ড ধাক্কা খেল।
অবিনাশ একটু পরে বললে, ইনহিউম্যান।
এই শব্দটা ধ্রুবর মনের মধ্যেও সকাল থেকেই ঘুরছে। ওর কেবলই মনে প্রশ্ন জাগছে, ভদ্রলোক কোনও ব্যবস্থা করতে পারলেন কিনা। এই এত সব ফার্নিচার, হাঁড়িকুড়ি, একটা গোটা সংসার। হয়তো দশ কিংবা বিশ বছর ধরে একটু একটু করে সাজিয়েছিলেন। এখন কোথায় নিয়ে গিয়ে তুলবেন! স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোথায় গিয়ে উঠবেন?
ধ্রুব বললে, ভদ্রলোক হয়তো ইদানীং অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ভাড়া বাকি পড়েছিল। অসুখ-বিসুখ চললে কার মনে থাকে!
অবিনাশ বললে, উহু, সেও তো আজকাল ইনস্টলমেন্টে দেওয়া যায়। অবশ্য জানি না…
ভাড়া বাকি পড়ার কথাটাই ভাবতে ভাল লাগছিল ধ্রুবর। কারণ, তা হলে ও নিশ্চিন্ত। ভাড়া বাকি ফেলার কথাই ওঠে না ওর ক্ষেত্রে। ফাইলের মধ্যে রসিদগুলো ঠিক ঠিক সাজিয়ে রেখেছে।
বেশ বোঝা গেল অবিনাশ নিজেও চিন্তিত। অবিনাশও তো ভাড়া বাড়িতেই থাকে, স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে। প্রথম জীবনটা ওর কেটে গেছে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে, তারপর একটু সচ্ছল হতেই গ্রামের বাড়ি থেকে সংসার তুলে এনেছে।
ধ্রুব বললে, আমি ভাবছি ভদ্রলোকের কথা। আজকাল তো সকলেরই মাত্র দুতিনখানা ঘর নিয়ে সংসার, বেচারির কোনও আত্মীয়টাত্মীয় থাকলেও কি আর থাকার জায়গা পাবে!
অবিনাশও যেন ভদ্রলোকের জন্যে চিন্তিত। বললে, সত্যি, রাতটা কোথায় যে কাটাবে। তাছাড়া অত সব জিনিসপত্র। কি করবে কে জানে।
দুজনই সেই অজানা অচেনা ভদ্রলোকের সমস্যার কথা ভেবে দুশ্চিন্তায় ড়ুবে গেল।
ধ্রুব হঠাৎ বললে, বোধহয় ভাল করে মামলা লড়তেও পারেনি। অবস্থা তো তেমন ভাল নয়, তোলা উনোন ছিল, গ্যাস স্টোভ কি সিলিন্ডার তো দেখলাম না। ফ্রিজও না।
কথাটা বললে বোধহয় মনে জোর পাবার জন্যে। অথাৎ প্রয়োজন হলে ও নিজে কিন্তু ভাল উকিল দিয়ে মামলা লড়তে পারবে। ওর গ্যাস স্টোভও আছে। ফ্রিজও আছে। এই সব দুঃস্থ টাইপের লোকদের সঙ্গে এতদিন ও খুব একটা একাত্ম বোধ করেনি। বরং দূরত্ব রেখেই চলত। অভাবে ওদের স্বভাব নষ্ট হয়, অনেকসময় ওদের ছেলেমেয়েরা বিগড়ে যায়, এই সব যুক্তি বানাত। অথচ এখন ওই ভদ্রলোক যেন আপনজন হয়ে উঠেছেন। কারণ উনিও ভাড়াটে।
অবিনাশ চাপা দুশ্চিন্তার হাসি হেসে বললে, রসিদৗসিদগুলো দেখে রাখতে হবে, শালা এমনিতেই তো জল দেয় না।
তারপর একটু থেমে বললে, আমাদের পাড়ায় অবশ্য একজনকে গুণ্ডা লাগিয়ে তুলে দিয়েছিল, সে অনেককাল আগে।
ধ্রুব অবাক হয়ে বললে, গুণ্ডা লাগিয়ে? এই কলকাতা শহরে?
অবিনাশ হাসল।–হ্যাঁ হে, এই কলকাতায়। এখানে কি না হয়? তবে সে ভদ্রলোক মামলা লড়ে ফিরে পেয়েছিলেন, কিন্তু লজ্জায় আর আসতে চাইলেন না।