চটি ছিঁড়ে গিয়েছিল বলে প্রীতিকে একদিন বলেছিল, মুচিটা যখন যাবে এদিক দিয়ে, ডেকে দিয়ে তো!
সঙ্গে সঙ্গে ভুরু কুঁচকে ফিরে তাকিয়েছিল প্রীতি। প্রায় ধমকের সুরে বলেছিল, মুচি আবার কি? জুতো সারাই বলতে পার না! বাথরুম পরিষ্কার করতে আসে যে লোকটা, তাকে জমাদারও বলা যাবে না। একদিন বলেছিল, কেন, ওর কি নাম নেই? রঘুয়া বললেই তো পারো। কথাগুলোর পিছনে যুক্তি আছে, কিন্তু অভ্যাস কি এত সহজে বদলানো যায়। প্রীতিই বা কি করে অভ্যাস বদলে নিল। ওরা, মেয়েরা বোধহয় এসব চটপট পারে।
ধ্রুব শুনতে পেল, ওদিকের বারান্দায় প্রীতি হেসে হেসে কাজলের সঙ্গে কথা বলছে। রান্নার লোক সুধাব সঙ্গেও এভাবেই কথা বলে। ওদের কারও সামান্য অসুখবিসুখ হলে কত মিষ্টি মিষ্টি করে খোঁজ খবর নেয়, উপদেশ দেয়, এমন কি দুচারটে ওষুধের বড়িও।–দেখো কাজল, মনে করে খেয়ো কিন্তু, দিনে তিনবার।
আসলে এ-সবই এক ধরনের তোষামোদ। কাজল একদিন না এলে, কিংবা সুধা অসুখে দুদিন পড়ে থাকলে ও যে চোখে অন্ধকার দেখবে। সে জন্যেই এত হেসে হেসে কথা।
তোষামোদ দরকার হয় না শুধু ধ্রুবর বেলায়, তখন আর মুখে হাসি আসে না।
ধ্রুব একদিন বলেছিল, ওদের এত তোয়াজ করে কি হবে, পাঁচটা টাকা কোথাও বেশি পেলেই তো কেটে পড়বে। তখন আর…
প্রীতি রেগে গিয়ে বলেছিল, হেসে হেসে কথা বলব না তো কি দিনরাত ওদের নিয়ে অশান্তি করব।
সকলের সঙ্গে দিব্যি শান্তি বজায় রেখে চলবে প্রীতি, কিন্তু ধ্রুবর ভালমানুষিতেই ওর আপত্তি। যাও, বাড়িওয়ালা রাখালবাবুকে কড়া করে বলে এসো। অথচ ও বাড়িওয়ালা লোকটিকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলতে চায়, মুখোমুখি হলেই উদ্বেগ বাড়ে, অশান্তি বাড়ে। এমনকি ভাড়া দেওয়ার পর রসিদটা দিতে দুএক সপ্তাহ দেরি করলেও ওর কাছে গিয়ে মনে পড়াতেও ইচ্ছে করে না। রাখালবাবুদের চাকর-বাকরকে বলে, বাবুকে বলিস, রসিদটা এখনও পাইনি। কিংবা গোঁপওয়ালা বিহারী দারোয়ানকে বলে বাবুকে মনে পড়িয়ে দিতে।
তারপরও হা-পিত্যেশ করে বসে থাকা, কবে বাবুটি রসিদ পাঠাবেন। আর রসিদে কে যে সই করে কে জানে, ধ্রুব প্রথম দিকে রসিদের সঙ্গে সই মিলিয়ে দেখেছে; এখন আর একেবারেই মেলে না। এ-সবে কোনও আইনের প্যাঁচ আছে কিনা তাও জানে না। অথচ ধ্রুবর ভদ্রতাবোধে লাগে, বলতে পারে না, মশাই সইটা আমার সামনেই করুন। কিংবা টাকা দিচ্ছি, রসিদটা এখনই দিয়ে দিন।
এ যেন জমিদার আর প্রজার সম্পর্ক। ভাড়ার টাকাটা দিতে যাবার সময় নিজেকে বড় ছোট লাগে।
অফিসের অবিনাশ হাসতে হাসতে বলেছিল, যত কমিউনিজম গ্রামের জমি নিয়ে, কলকাতায় যোলো আনা ধনতন্ত্র।
ধ্রুব বলেছিল, ধনতন্ত্র বলছ কেন, এখনও সেই ফিউডেলিজ। দশ বিশখানা বাড়ি থাকলেও কোনও আপত্তি নেই।
ও-সব কথা বলে মনের ঝাল মেটানো যায়। কিন্তু বুকের ভিতর থেকে উদ্বেগ দূর করা যায় না। ভাড়াটে হয়ে থাকা মানেই একটা চিরন্তন অশান্তির সঙ্গে সহবাস করা।
সকালে দেখা দৃশ্যটা বারবার মনে পড়ছিল বলেই খুব মন থেকে উদ্বেগটা দূর করতে পারছিল না। সকলেই তো বলে আজকাল নাকি ভাড়াটেকে তুলে দেওয়া যায় না। তা হলে ওই দৃশ্যটা দেখতে হল কেন?
শেষ অবধি অবিনাশকেই বললে।
অবিনাশের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া কিছু জমিজমা আছে হুগলিতে। গ্রামে চাষবাস হয়। এখানে বাড়ি ভাড়া করে আছে, কিন্তু র্যাশনকার্ড জমা দিয়ে পারমিট করিয়ে দারুণ ভাল চাল নিয়ে আসে গ্রাম থেকে।
ধ্রুব ওকে তাই ঠাট্টা করে বলে জমিদার।
অবিনাশের বেশ কিছু জমি ভেস্ট হয়ে গেছে, ক্ষতিপূরণের টাকা এখনও পায়নি। পেলেও তা সামান্য টাকা, সেজন্যে ঘুষ-ঘাস দিয়ে আদায় করার চেষ্টাও করেনি। বলে, যা ছোটাছুটি করতে হবে খরচ পোষাবে না।
কলকাতার বাড়িওয়ালাদের ওপর ওর রাগ সেজন্যেই। রাগ আসলে বাড়িওয়ালাদের ওপর, না কি আইনকানুনের ওপর, তা ঠিক বোঝা যায় না। আসলে ভেস্ট হয়ে যাওয়া জমির মায়া ও ভুলতে পারে না। বলে, কলকাতার একটা ফ্ল্যাটের দাম তো গ্রামের একশো বিঘে জমির চেয়ে বেশি। কিন্তু এখানে কোনও গরমেন্টই হাত বাড়াবে না।
অবিনাশকে কিন্তু বর বেশ ভালই লাগে। ওর দেশে জমিজমা আছে বলে কোনও ঈষাও হয় না। বরং অবিনাশও ভাড়াটে বলে কেমন এক ধরনের আত্মীয়তা বোধ করে।
বেশ প্রাণখোলা মানুষ এই অবিনাশ। গায়ের রঙ চাপা, কালোই বলা চলে। চুলে ঈষৎ পাক ধরেছে। পাঞ্জাবির ওপর একটা জহরকোট পরে। মাঝে মাঝেই দাড়ি কামাতে ভুলে যায়, কিংবা দাড়ি কামায় না। কেউ সেকথা বললে হাসতে হাসতে বলে, কি হবে গাল চকচকে করে, অফিসার করে দেবে? না কি এ বয়সে কোনও মেয়ে এসে গালে হাত বুলিয়ে দেবে?
যেন প্রতিদিন দাড়ি কামানোর প্রয়োজন ওইসব কারণেই।
সকাল থেকেই ধ্রুবর মনে অনেকগুলো প্রশ্ন। প্রীতির কাছ থেকেও শুনতে পায়নি কাজল কি জেনে এসেছে।
ও তো এতদিন বেশ নিশ্চিন্ত ছিল। রাখালবাবু যত অশান্তিই ঘটাক, ওকে তো আর বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারবে না। আইন ভাড়াটেদের পক্ষে।
কিন্তু তা হলে ওই ভদ্রলোকের আসবাবপত্র টেনে বের করে দিল কি করে? ভাড়া বাকি পড়েছিল? ভাড়া দিত না?
শেষে অবিনাশকেই বললে।
–আজ সকাল থেকেই ভাই মনটা খারাপ হয়ে আছে।
খাটো মাপের চেহারায় খাদির খয়েরি জ্যাকেটে অবিনাশকে আরো বেঁটে লাগে। কিন্তু সবসময়েই মুখে হাসি লেগে থাকে বলে দাড়ি কামিয়েছে কি কামায়নি চোখে পড়ে না।