ওর নিজেরই দোষ কিনা জানে না।
এখন প্রীতিও বলছে, তুমি না, কেমন যেন বদলে যাচ্ছ!
ধ্রুব মনে মনে বললে, বদলে যেতেই তো চাই। আমি তো বাড়ি বদল করেছি। বাড়ি বদল মানে তো শুধু একটা বাড়ি থেকে আরেকটা বাড়িতে যাওয়া নয়।
এসে একদিন প্রীতিকে বললে, চলো অরিন্দমবাবুদের বাড়ি যেতে হবে। উনি আজ আমাদের চায়ের নেমন্তন্ন করেছেন।
প্রীতি অবাক হয়ে বললে, অরিন্দমবাবু, সে আবার কে?
–বাঃ, তোমাকে তো কতদিন বলেছি, প্রায়ই দেখা হয়। নামগুলো তো মনে রাখবে।
তারপর ধীরে ধীরে বললে, ওই তিনতলা বড় বাড়ি, ওঁরই। বলেছেন, ওঁর কপোরেশনে চেনা আছে, বাড়ির ট্যাক্সটা যাতে কম হয় ব্যবস্থা করে দেবেন।
প্রীতি শুধু বললে, ও।
গেল। কিন্তু খুব মন খুলে আলাপ করল না। বোধহয় ভদ্রলোকের গিন্নিকে পছন্দ হয়নি। পছন্দ হবার কথাও নয়। বেশ বয়স্ক, জবুথবু। একটু প্রাচীনপন্থী।
অরিন্দমবাবুকেও ধ্রুবর খুব ভাল লাগেনি। কেবল ঘরের মোজেক দেখাচ্ছিলেন। কী রকম পালিশ দেখেছেন? ডিজাইনটা আর কোথাও দেখবেন না। বারান্দার গ্রীল দেখাচ্ছিলেন।
তবু বন্ধু মনে হল তাঁকে। অরিন্দমবাবু বললেন, ট্যাক্স নিয়ে আপনি ভাববেন না, আমার লোক আছে। এই গোটা বাড়ির কত ট্যাক্স করিয়েছি জানেন, মাত্র একশো কুড়ি।
বলে হো হো করে হাসলেন।
ফেরার সময় ধ্রুব বলেছিল, যাই বলল, ভদ্রলোক খুব পরোপকারী। যেচে কে এই উপকার করে আজকের বাজারে।
পরোপকারী কথাটা নিজের কানেই খট করে লাগল। পরের উপকার? কিন্তু অরিন্দমবাবু কি ধ্রুবকে পর ভাবছেন? নাকি ধ্রুবই ওঁকে পর ভাবছে। কেমন যেন আপন আপন মনে হচ্ছে। শুধু স্বার্থের জন্যে? না কি স্বার্থই ওদের এক করে দিয়েছে, আপন করে দিয়েছে।
হয়তো তাই।
সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি। রাস্তায় রাস্তায় জল জমে গেছে। অফিস থেকে বেরিয়ে ভেবেছিল ট্যাক্সি করেই বাড়ি ফিরবে। কিন্তু পকেটে টাকাও বেশি ছিল না। আজকাল খরচ কমানোর চেষ্টা করছে, সেজন্যেই পকেটে টাকাও বেশি রাখে না। থাকলেই খরচ হয়ে যায়। ভয় হল, জ্যামে আটকে গিয়ে মিটার কোথায় উঠবে কে জানে। শেষে বাড়ি পর্যন্ত যদি না আসে, মাঝপথে টাকা দিতে পারবে না।
দু দুবার বাস বদলাতে গিয়ে একেবারে কাকভেজা।
বাড়ি ফিরেই শুনতে পেল প্রচণ্ড উল্লাস। হাসিহল্লা।
বেল বাজানোর পর এসে দরজা খুলতেও দেরি করল প্রীতি। কিংবা একে ক্লান্ত তার ওপর ভিজে গেছে বলেই ধ্রুবর মনে হল দরজা খুলতে বড় বেশি দেরি করছে প্রীতি।
রাগ চেপে রাখার চেষ্টা করল।
কিন্তু ঢুকেই চক্ষুস্থির। জামাকাপড় বদলানোর জন্যে বসার ঘরে এসে অপেক্ষা করল। প্রীতি শুকনো জামাকাপড় এনে দিয়ে গেল।
এক ঝলক দেখেছে, তাতেই বিরক্তি। সুখেনবাবুর স্ত্রী।
ওঁরই সঙ্গে এত হাসিগল্প। এত হলা। দুড়মদাঁড়াম করে দেয়াল খুড়ছিল বলে জীবনবাবু একটু আপত্তি করেছেন, তাঁরই তো বাড়ি, মায়া হবে না। তার জন্যে বাড়ি বয়ে বলতে এসেছিলেন এই সুখেনবাবুরা।
উদ্দেশ্য তো একটাই। অরিন্দমবাবুর বিরুদ্ধে পাড়ায় প্রোপাগাণ্ডা করা।
অনেকক্ষণ ধরে বসার ঘরে বসে বসে রাগ চাপছিল খুব। ভদ্রমহিলার যাবার নাম নেই।
শেষে শুনতে পেল, ভদ্রমহিলা বলছেন, ছাতাই দাও ভাই, চলে যাই। কতক্ষণ আর উনি বসে থাকবেন।
একথাটা যেন আগে বলা যেত না।
উনি চলে যেতেই রাগে ফেটে পড়ল ধ্রুব।
–বার বার বলেছি, ওদের সঙ্গে মেলামেশা করো না, করো না।
প্রীতি অবাক হয়ে বলল, কেন, কি করল ওরা? বরং আমি একা একা থাকি, উনি এলেন বলে তো..
খুব গলার স্বর তুলল।–মেলামেশার আরো ভোলোক আছে। এখন তো খুব হাসাহাসি, নীচের তলায় যদি ভাড়াটে বসাই, তখন দেখবে তার সঙ্গে দল বাঁধছে। সব চেনা আছে আমার।
প্রীতি বিভ্রান্তের মতো তাকিয়ে রইল ধ্রুবর চোখের দিকে।
ধ্রুব তখনও ক্রমশ উত্তেজিত হচ্ছে।
বললে, ওরা তো শুধু নিজেদের স্বার্থ দেখে। গল্প বলতে তো, বাড়িওয়ালা মাথার ওপর শিলনোড়ায় মশলা বাটে, বললেও শোনে না। কিংবা এই সেদিন এসেছি, এর মধ্যে ভাড়া বাড়াতে বলছে। আর নয়তো ওই এক কথা, জল দেয় না। ওরা একটা আলাদা ক্লাশ, বুঝলে!
প্রীতি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ধ্রুবর চোখের দিকে। তারপর কেমন একটা রহস্যের হাসি হাসল।
আর ধীরে ধীরে বললে, বাড়িটা সত্যি বদলে গেছে।
———–