প্রীতির নিজেকে বেশ সুখী মনে হয়। ধ্রুবরও। যেন জীবনের কাছে সব চাওয়া ফুরিয়ে গেছে। এই বয়েসেই। এখন শুধু টিপুকে মানুষ করে তোলা। ও তো আপনা থেকেই হবে। শুধু একটা ভাল স্কুলে ভর্তি করে দিলেই হবে।
এর মধ্যে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে সেই হাত কাটা দালালটা একদিন এসে হাজির। কিছু ঠিক করলেন স্যার, ভাল পার্টি আছে, অবাঙালি চান অবাঙালি, বাঙালি চান বাঙালি…
ধ্রুব তাকে ফিরিয়ে দিল। এখন নয়, এখন নয়।
আরো দুচারজন এসেছে, আপনা থেকেই। বিব্রত, বিরক্তবোধ করেছে ধ্রুব। নীচের তলাটা খালি পড়ে থাকাও যেন এক অশান্তি।
–শালা ভাড়াটেদের জ্বালায় টেকা দায়।
একজনের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে ধ্রুব বললে।
প্রীতিও সমান বিরক্ত। বললে, সামনে লিখে দাও, ভাড়া দেওয়া হবে না।
ধ্রুব হাসল। তা হলে তো আরও বিরক্ত করবে। সবাই জেনে যাবে নীচের তলা খালি আছে।
আসলে ধ্রুব এখনও মনস্থির করতে পারছে না, ভাড়া দেবে কিনা। ভাড়া না দিয়ে যদি ধার দেনা শোধ হয়ে যায়! না, ওর কেবলই ভয়, হয়তো ঠকে যাবে। হয়তো আরো ভাড়া বাড়বে, তখন ভাড়াটে তুলতে পারবে না।
ভাড়াটেকে খোলা এ বাজারে যে কঠিন কাজ, ধ্রুব জানে। ওর মতো সকলেই তো আর বাড়ি করে উঠে আসতে পারে না। তাই সব অত্যাচার সয়েও দাঁত কামড়ে পড়ে থাকে। উঠে আসতে কি আর পারে না, চেষ্টাই করে না। ধ্রুবর তো এখন তাই মনে হয়। ও পারল কী করে।
অফিসে অবিনাশ তো ঠাট্টা করে ওকে মূখ বলল। ভাড়ার ফ্ল্যাট এমনি এমনি ছেড়ে দিয়েছে শুনে বলে উঠল, তুমি তো একটি মুখ হে। এমনি কখনো ছাড়ে? জানো, পঞ্চাশ হাজার দিলেও ভাড়াটে ওঠে না। আদায় করে নিতে হত।
ধ্রুব হেসেছিল ওর কথা শুনে।
অবিনাশ বলেছে, হাসির কী আছে? এটা তোমার রাইট। ও লোকটা আইনের জোরে বাড়িওয়ালা, তুমি আইনের জোরে ভাড়াটে। যখন ভাড়া দিয়েছিল তখন তো ও অনেক দেখেশুনে দিয়েছে। কার বেশি দরকার তা তো দেখেনি, যে ভাড়া বেশি দেবে, ভাড়া ঠিক ঠিক দিতে পারবে তাকেই দিয়েছে। সবাই তাই দেয়। স্বার্থ দেখে। তা হলে ভাড়াটেই বা স্বার্থ দেখবে না কেন?
শুনে সমস্ত মন তেতো হয়ে গিয়েছিল। অবিনাশের কাছে এই কথাগুলো শুনে খুব রীতিমত ভয় পেয়ে গেছে। ও যদি ভাড়া দেয়, ভাড়াটেকে তুলতে চাইলে সেও এরকম টাকা চেয়ে বসবে হয়তো। অথচ ভিতরে ভিতরে একটা লোভ। ভাড়া দিলে তাড়াতাড়ি ধারদেনা শোধ করে দেওয়া যাবে।
এখন ধ্রুবর কাছেও ভাড়াটেরা একটা আতঙ্ক।
আসা-যাওয়ার পথে পাড়ার সুখেনবাবুর সঙ্গে আলাপ। মাঝে মাঝেই দেখা হত, আর ভদ্রলোক টানাটানি করতেন, আসুন, চা খেয়ে যান। কিংবা স্ত্রীকে নিয়ে একদিন আসুন।
ভদ্রলোকের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে, হাঁটা-চলা দেখে ধারণা হয়েছিল উনিই বাড়িটার মালিক। তা নয়, ভাল চাকরি করেন। অনেক টাকা ভাড়া দিয়ে আছেন।
একদিন সপরিবারে এলেন। ভদ্রলোকের স্ত্রী খুব জমিয়ে গল্প করতে পারেন। যতক্ষণ ছিলেন সময় যে কীভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারেনি ওরা।
যাবার সময় বললেন, নিজে বাড়ি করেছেন, অনেক শান্তিতে আছেন। আমাদের যা বাড়িওয়ালা মশাই, ছবি টাঙাব বলে দেয়ালে একটা পেরেক ঠুকছি, গুণ্ডামতো ছেলেটা ছুটে এসে সে কি হম্বিতম্বি।
সুখেনবাবুর স্ত্রী বললেন, ছোটলোক, ছোটলোক।
চলে গেলেন ওঁরা, কিন্তু ধ্রুবর সমস্ত মন বিস্বাদ করে দিয়ে।
ধ্রুবর তো এই দুমাসের মধ্যেই বাড়িটার ওপর মায়া পড়ে গেছে। মনে হচ্ছে এর চেয়ে ভাল জায়গা ভাল বাড়ি যেন হতে পারত না।
দরজার ঝকঝকে নব দুবেলা ঘষেমেজে চকচকে করে রাখে প্রীতি।
বলছিল, জিনিস রাখার জন্যে রান্নাঘরে কয়েকটা কাঠের খোপ বানিয়ে নেবে।
—আর হ্যাঁ, বসার ঘরের জন্যে বেশ বড় একটা ছবি। কোনও মডার্ন আটিস্টের। প্রীতি বলেছিল, বসার ঘরে কোনও অরিজিনাল পেন্টিং না থাকলে ড্রয়িং রুম বলে মনেই হয় না।
ধ্রুবর মডার্ন আর্ট অত পছন্দ নয়। বলেছিল, যামিনী রায়।
প্রীতি উল্লসিত। –তা হলে তো কথাই নেই, কিন্তু অরিজিন্যাল!
এখনও ওদের বাড়িটাকে ঘিরে নানা স্বপ্ন। যেমন টিপুকে ঘিরে। বাড়িটাও যেন আরেকজন টিপু। আসলে এও তো রক্তমাংস দিয়েই গড়া। শেষে কি একজন ভাড়াটে এসে দুম দুম করে এর দেয়াল খুঁড়তে আরম্ভ করবে নাকি। সে এক আতঙ্ক।
সুখেনবাবুর কথাটা মনে পড়ে গেল। বললে, ভাড়াটে, তার আবার ছবি টাঙানোর শখ।
ওর স্বগতোক্তি প্রীতির কানে গেল।–আগের ফ্ল্যাটে আমরাও তো টাঙিয়েছিলাম। তুমি না, কেমন যেন বদলে যাচ্ছ।
ধ্রুব বললে, বদলে যাচ্ছি না, বদলে গিয়েছি। এখন আমি সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তখন পেতাম না।
প্রীতি ভুরু কুঁচকে তাকাল ধ্রুবর চোখের দিকে।–তুমি কি যেন হয়ে যাচ্ছ।
ধ্রুব চুপ করে গেল। ও কি সত্যি সত্যি বদলে যাচ্ছে নাকি?
তা না হলে ও সুখেনবাবুকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলতে চাইল কেন? ওঁরা তা নিজে থেকেই একদিন আলাপ করতে এসেছিলেন। ধ্রুব কথা দিয়েছিল, ওরাও একদিন যাবে।
কিন্তু গেল না।
প্রীতি একদিন বলেছিল। ধ্রুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেছে, না না, অত মেলামেশার কি দরকার।
একটু পরে বলেছে, জীবনবাবুকে চটিয়ে কি লাভ।
জীবনবাবু অথাৎ সুখেনবাবুর বাড়িওয়ালা। লোকটিকে ভালই লাগে ধ্রুবর। খুব খোলামেলা। কথাবার্তায় কোনও রাখাঢাকা নেই।
এখানে এসে ও ভেবেছিল সকলের খুব বন্ধু হয়ে যাবে। প্রথম প্রথম বোধহয় চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু পারেনি। কেন, কে জানে।