ধ্রুব রাগের গলায় বললে, ওদের বলে দিও, আমার একটা আত্মসম্মান বলে জিনিস আছে।
আবার কি একটা ঝামেলা হয় এই ভয়ে মা বললেন, না না, ওরা সেভাবে বলেনি, ধার নেয়ার কথা বলছিল…
ধ্রুব হেসে বললে, না, তাও নিইনি।
একটু থেমে বললে, ধার দেওয়ার মতো অবস্থাও তাঁর নয়।
ফেরার পথে প্রীতিকে কথাটা বলতে পারল না। চেপে গেল। শুনলে বড়বৌদি আর মেজবৌদির ওপর আবার রেগে যাবে। উল্টে হয়তো ভাববে, ধ্রুব যখন চতুর্দিকে লোনের চেষ্টা করছে, তখন হয়তো ভেবেছে, প্রীতি কেন তার বাবাকে বলছে না। একবার লোভ সত্যি হয়েছিল ধ্রুবর, কথাটা প্রীতিকে বলার। ভাগ্যিস বলেনি।
এখন জানে, উনি দিতে পারতেন না। উল্টে না দিতে পারার জন্যে লজ্জা পেতেন।
অথচ প্রীতি যদি শোনে ও মাকে বলেছে, ধার দেওয়ার মতো অবস্থাও তাঁর নেই, তা হলেও রেগে যাবে। শ্বশুরবাড়িতে বাবার দুরবস্থার কথা প্রকাশ করে দেওয়ার কি দরকার ছিল। শ্বশুরের কাছে ধার নিতে আমার আত্মসম্মানে বাধে, এটুকু বললেই তো পারতে।
হয়তো রেগে গিয়ে বলত, ওদের কাছে আমার বাপের বাড়িকে ছোট করে তোেমার কি লাভ হল!
বাড়ি ফিরেই মেজাজটা আরো বিগড়ে গেল।
ঢোকার আর বেরোনোর সময়টা বড় অস্বস্তিতে কাটে। গোঁপওয়ালা বিহারি দারোয়ানটা আজকাল এতটুকু সমীহ করে না। আগে করত। এমন ভাবভঙ্গি করে যেন ধ্রুব এই ফ্ল্যাটে থাকে না। ধ্রুব বেশ বুঝতে পারে এর পিছনে রাখালবাবুর উৎসাহ আছে। কিংবা কে জানে, ওঁদের কথাবার্তা শুনে লোকটা সব বুঝে নিয়েছে।
কিন্তু মেজাজ আরো বিগড়ে গেল হাতকাটা দালালটাকে দেখে।
ধ্রুবর জন্যেই অপেক্ষা করছিল।
কনুই থেকে ফুলহাতা শার্টের হাতাটা ঝুলছে, সেই হাতটাই নেড়ে বললে, এই ফ্ল্যাটটা আমিই আপনাকে দেখে দিয়েছিলাম।
ধ্রুব রেগে গিয়ে বললে, সে আর মনে নেই? এই রকম একটা বাড়িওয়ালার কাছে জেনেশুনে…
একমুখ হাসল লোকটা। বাড়িওয়ালা বাড়িওয়ালার মতোই তো হবে বাবু?
—তা তুমিও কি জানতে এসেছ কবে উঠে যাচ্ছি?
আবার হাসল।–হ্যাঁ, সেকথাই বলতে এলাম। আমাকে একটু আগে থেকে বলবেন, আবার অন্য কোনও দালাল না মেরে দেয়। আগে থেকে জানলে, আমার লোক নিয়ে আসব, কটা টাকা পেতাম, দেখছেন তো হাতটা কাটা। কিছুই করার নেই। দুটো পয়সা যদি পাই দালালি করে…
ধ্রুব বললে, ঠিক আছে, বলব।
লোকটা তবু দাঁড়িয়ে রইল। আরেকটা কথা বলছিলাম। আপনার তো বাড়ি হয়ে গেছে, নীচের তলাটা নাকি ভাড়া দেবেন…
–সে কথাও জেনে গেছ?
লোকটা হাসল। ঘাড় নেড়ে জানাল, হ্যাঁ।
লোকটাকে বলতে পারত, পরে বলব। কিংবা ভাড়া দেব না।
তবু একটু যাচিয়ে দেখতে ইচ্ছে হল।
জায়গাটার মোটামুটি একটু ধারণা দিল। বললে, দুখানা ঘর, ভিতর দিকে বারান্দা, সামনে ব্যালকনি…
–ব্যালকনি আছে? লোকটা খুব খুশি।
ধ্রুব বললে, সে তো দোতলায়।
-কিচেন খুব ছোট নয় তো?
ধ্রুব বললে, না।
লোকটা বললে, খুব ভাল পার্টি আছে, আজ রাত্রেই নিয়ে আসব স্যার। অ্যাডভান্স দেবে মোটা টাকা। কত চান বলুন…
লোকটা যেন ক্রমশই উত্তেজিত হয়ে উঠছিল।
ধ্রুব বললে, এখন নয়, এখন নয়।
কোনওরকমে তাকে বিদায় দিল।
তারপর নিজেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করল।
ভিতরের রঙ আগেই হয়ে গিয়েছিল, বাড়ির বাইরেটায় রঙ পড়তেই সমস্ত পাড়াটাই যেন ঝলমল করে উঠেছে। ধ্রুব যখনই বাড়ি ফেরে, অফিস থেকে, কিংবা বাজারের থলি হাতে নিয়ে, প্রাণভরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। দেখে আর গর্বে, পুলকে বুক ভরে ওঠে। মনে মনে বলে আমার বাড়ি, নিজস্ব বাড়ি।
এর প্রতিটি ইট যেন ধ্রুবর স্বপ্ন দিয়ে গাঁথা। কৃচ্ছসাধনই কি কম আছে এর পিছনে, কে তার খোঁজ রাখে। পরিশ্রম, উদ্বেগ, অর্থ, কি না দিয়েছে এই বাড়ির জন্যে।
আমার নিজের বাড়ি। বলতেও আনন্দ।
ধ্রুব, প্রীতি আর টিপু। দেখতে দেখতে টিপু কত বড় হয়ে গেছে। মাস দুই হল ওরা এই নতুন বাড়িতে উঠে এসেছে। ভাবছে, টিপুকে এবারই পাড়ার স্কুলে ভর্তি করে দেবে।
সেখানেই খবর নিতে গিয়েছিল। রিকশা করে ফিরছিল।
রিকশা থেকেই বাড়িটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল ধ্রুব।
–যাই বলল, রঙটা কিন্তু চমৎকার ম্যাচ করে করেছে। জগন্নাথবাবু ভদ্রলোকের রুচি আছে।
প্রীতি বললে, তুমি তো প্রথমে আপত্তি করেছিলে, উনিই বললেন খুব ব্রাইট দেখাবে।
ধ্রুব বললে, তখন কি ছাই এ-সব বুঝতাম। এখন আমি নিজেই কন্ট্রাক্টর হয়ে যেতে পারি, সব জেনে গেছি।
প্রীতি হেসে ফেলল।–তা হলে সেই কাজই শুরু করে দাও।
তারপর বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললে, যাই বলো, আমাদের বাড়িটাই কেস্ট, এ পাড়ায়।
ধ্রুবরও সেরকমই মনে হচ্ছিল। আশেপাশে কয়েকটা বেশ বড়সড় বাড়িও আছে, কিন্তু সেগুলোকে এখন আর তেমন সুন্দর লাগছে না। হয়তো অনেককাল বাইরেটা রঙ করেনি বলে, রোদে-জলে কেমন মরামরা লাগে। দু-একটা বাড়ির রঙ নতুন, কিন্তু কোনও রুচি নেই। নীল কিংবা সবুজ ঢেলে দিয়েছে।
প্রীতি একটা বাড়ির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললে। হরিবল, এই রকম ব্লু কেউ দেয়!
ধ্রুব গম্ভীরভাবে বললে, ওটা সুধীনবাবুর বাড়ি, চমত্ত্বার লোক। এমন ভদ্র আর মিশুকে, কোনও গর্ব নেই…
প্রীতি আর কিছু বলল না।
এ পাড়ায় উঠে এসেই ধ্রুব অনেকের সঙ্গে আলাপ করে ফেলেছে। প্রীতির এখনও চেনাজানার গণ্ডি তেমন বাড়েনি। কে কেমন লোক ও কিছুই জানে না।
জানার দরকারও নেই। বাড়ির দোতলার ব্যালকনিতে বেতের চেয়ারে এলিয়ে বসে সিনেমার ম্যাগাজিনের পাতায় ড়ুব দিয়ে ওর অবসর কেটে যায়।