ধ্রুব কোনও উত্তর দিল না। আত্মীয়কে কেউ বাড়ি ভাড়া দেয় নাকি। নিয়মিত ভাড়া দিলে তখন কিছু বলাও যাবে না। আত্মীয় তো দূরের কথা, বাঙালিকেই দেবে না। অবাঙালির মতো অত টাকা এরা দিতে পারবে নাকি।
প্রীতি অবশ্য একদিন বললে, বাঙালি ভাড়াটে হলেই কিন্তু ভাল হত। একটা কথা বলার লোক পেতাম।
ধ্রুব বললে, কথা বলার? না ঝগড়া করার? সম্ভব হলে ভাড়াই দিতাম না। ভাড়াটে নিয়ে বাস করা মানেই অশান্তি।
প্রীতি সশব্দে হেসে উঠল। —এই, তুমি বাড়িওয়ালা হয়ে গেছ এর মধ্যে। এখনো তো আমরা ও বাড়িতে উঠে যাইনি।
ধ্রুবও হেসে ফেলল।–হ্যাঁ, এখন তো আমরা বাড়িওয়ালাই।
একটু থেমে বললে, ভেবেচিন্তে করতে হবে সব। বাজারে এখন যেভাবে ভাড়া বাড়ছে, দিয়ে ফেললে তখন আর বাড়ানো যাবে না।
প্রীতি হাসতে হাসতে বললে, কেন? সে তো আমরা শিখে নিয়েছি, জল বন্ধ করে দিলেই হবে। উঠিয়ে দিয়ে আবার বেশি ভাড়ায়…
ধ্রুব বললে, জল বন্ধ করলে সবাই কি আর উঠে যায়? যার উপায় নেই সে কি করবে?
তারপর হেসে বললে, তা দেখা অবশ্য আমাদের কাজ নয়। গভর্নমেন্টই তাদের কথা ভাবে না, বাড়িওয়ালারা ভাববে কেন!
একটা কি যেন চিন্তা করল, তারপর বললে, ভাড়া যতই বাড়ুক, তাতেও লাভ হয় না।
আগে এ সব বুঝত না। এখন হিসেব কষে।
–ধরো ডিবেঞ্চারে টাকা রাখলে ফিফটিন পার্সেন্ট সুদ।
প্রীতি বললে, তুমি তো দোতলায় থাকবে বলে দোতলা করেছ, নীচের তলা তো করতেই হত। এখন সেটাকেও ইনভেস্টমেন্ট ভাবছ কেন?
ধ্রুব ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বললে, কারণ লোন শোধ করতে হবে। এর পর কপোরেশন ট্যাক্স আছে, এটা ওটা সারানো আছে।
একটাই সুবিধে, জলের পাম্প করতে হয়নি। রিসার্ভয়েরটা এতই কাছে, তার প্রেসাবেই দোতলায় জল উঠে যায়।
জগন্নাথবাবু বলেছিলেন, পাম্পের দরকার হবে না।
একদিন গিয়ে দেখল। সত্যি, ট্যাঙ্ক ভর্তি হয়ে উপছে পড়ছে।
জগন্নাথবাবুর ওভারসিয়ারকে বললে, ট্যাঙ্কে একটা কল লাগিয়ে দেবেন।
প্রীতি ছিল সঙ্গে। বলল, কেন?
-পরে বলব।
পরে আড়ালে হাসতে হাসতে বললে, একটা সুবিধে কি জানো? পাম্প নেই, কতক্ষণ চালাচ্ছ তা নিয়ে ভাড়াটে ঝগড়া করতে পারবে না। যখন দরকার হবে, ধরো ভাড়াটে যদি মাথা নিচু করে থাকে, সে অন্য কথা, তা না হলে জল উঠবে একদিকে, কল খুলে আরেকদিকে বের করে দাও। বেশি চিৎকার চেঁচামেচি করলে বলা যাবে এসে দেখুন, জল ওঠেই না। সবাই তাই করে।
প্রীতি হাসল। বললে, আমার কিন্তু আর একদিনও ও বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে না। চটপট সব করিয়ে নাও।
ধ্রুব নিজেও অধৈর্য হয়ে উঠছিল। শুধু সামনে এই স্বপ্নটা আছে বলেই ধৈর্য ধরেছে। একটা বাড়ি করতে যে এত সময় লাগে ও জানতই না। জগন্নাথবাবু তো প্রথমে অনেক কম সময় বলেছিলেন, কিন্তু পারলেন না।
হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে গেলে আজকাল প্রীতির খাতির যত্ন অনেক বেশি হয়। দূরে সরে আসার জন্যে ওরা কাছের মানুষ হয়ে গেছে বলে, নাকি বাড়ি করছে বলেই ওদের দাম বেড়ে গেছে।
বড়বৌদি বললে, একদিন চলো দেখিয়ে নিয়ে এসো। একজন অন্তত ভাড়াটে নাম ঘোচাল, দেখে আসব না?
দাদা বললে, সবই ভাল, বলছিস দুখানা ঘর এক এক তলায়, তিনখানা না হলে…
ধ্রুব বললে, প্ল্যানে আছে, ওটা পরে বাড়িয়ে নেব।
বড়বৌদি দাদাকে ধমক দিল।–তুমি থামো, দু’খানাও তত করেছে।
মেজবৌদি বললে, আমি বাবা রঙটঙ করার পর দেখতে যাব। রঙ না পড়লে বাড়ি ঠিক খোলতাই হয় না।
তারপর হাসতে হাসতে বললে, ধ্রুবদা, গৃহপ্রবেশে খুব খাওয়াতে হবে কিন্তু। তোমার পিসেমশাইদের মতোই, গোটা গোটা গলদা চিংড়ি আর মুর্গির ঠ্যাং।
সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
মেজদা বললে, হ্যাঁ, দেখিয়ে দিবি পিসেমশাইকে, আমরাও পারি। টাকা হয়েছে বলে ওঁর খুব গর্ব। কেমন বলছিলেন, পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাট জুড়ে নিয়েছি। আসলে বোধহয় বলতে চাইছিলেন, তোরা তো একটাই কিনতে পারলি না।
মেজদার কথাটা ধ্রুবর প্রথমে ভাল লাগেনি। পিসেমশাই না থাকলে বাড়িটাই তো হত না। উনি তো ও দু কাঠা অন্য কাউকেও দিতে পারতেন। অবশ্য বাইরের লোককে বোধহয় দিতে চাননি। গায়ে গায়ে বাড়ি, আত্মীয় খুঁজেছিলেন। কিন্তু জগন্নাথবাবু? উনিও তো বিশ্বাস করেছেন পিসেমশাই মাঝখানে আছেন বলেই। একজন টাকাওয়ালা লোক, অনেকদিনের পরিচয়…
কিন্তু মেজদার কথাটা শোনার পর ধ্রুবর মনে হল, পিসেমশাই একটু টাকাও দেখাতে চেয়েছিলেন। তা না হলে ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশে অত এলাহি কাণ্ড করার কি দরকার ছিল। এত লোককে নেমন্তন্নই বা কেন!
বাবা আর মার দারুণ আনন্দ।–কবে যাচ্ছিস?
মা বললেন, বাবাকে বলিস পাঁজি দেখে দিন ঠিক করে দেবে।
হাসতে হাসতে প্রীতিকে বললেন, আমি কিন্তু সত্যিনারাণ দিয়ে আসব বৌমা।
বাবা হাসতে হাসতে বললেন, হ্যাঁ, তোর মায়ের সত্যিনারাণের খুব পয়া আছে, বাড়ি হয়ে গেল।
মা বাধা দিয়ে বললেন, সে কথা বলো না, পয়া যদি কারো থাকে সে বৌমার।
প্রীতি খুব খুশি, কুলকুল করে হেসে উঠল। তোষামোদ করে বললেন, না, সে আপনাদের আশীর্বাদ।
এখন এ ধরনের কথা বলতে ওর অস্বস্তি নেই। আগে পারত না।
ধ্রুব চলে আসার আগে মা ওকে একটু আড়ালে নিয়ে গেলেন। চাপা গলায় জিগ্যেস করলেন, হ্যাঁ রে, শ্বশুরের কাছে কিছু নিসনি তো? বাড়ি করার জন্যে?
ধ্রুব চমকে উঠল। রেগে গেল।–কেন? তাঁর কাছে নিতে যাব কেন?
–না, সেকথাই জিগ্যেস করছি। তেমন হলে তোর বাবার শুনলে তো খারাপ লাগবে। বড় বৌমা বলছিল কিনা, অনেক টাকার ব্যাপার…