বাড়িওয়ালা উঠিয়ে দিতে চাইছে। সুতরাং উঠে যাওয়াটাই নাকি ভদ্রতা।
হয়তো বলে বসবে, এত অপমান সহ্য করে থাকেন কী করে?
রাখালবাবু হয়তো দূর থেকেই দেখতে পেয়েছিলেন। মর্নিং ওয়াক করে ফিরছেন। ঢিলেঢালা প্যান্টে যতটা সম্ভব স্মার্ট হয়ে হাঁটছিলেন।
দেখতে পেয়েই হয়তো ফুটপাথ বদলে নিলেন, ফলে একেবারে সামনাসামনি। সমস্ত মন বিস্বাদ হয়ে গেল ধ্রুবর।
রাখালবাবু একমুখ হেসে বললেন, সুখবরটা জানাওনি তো এতদিন? তোমাদের নাকি বাড়ি হয়ে গেছে?
ধ্রুবকে হাসতে হল। বললে, হয়ে গেছে বলবেন না, হয়ে আসছে।
—তা কবে নাগাদ উঠে যাবে ঠিক করেছ?
ধ্রুবর মন তেতো হয়ে গেল। সঠিক কোনও উত্তর দিল না। দেবেই বা কী করে। ও নিজেই তো জানে না। জলের পাইপ, বাথরুম, ইলেকট্রিক।
শুধু বললে, উঠে যেতে পারলে তো আমারও লাভ, মাসে মাসে ভাড়া গুনতে হবে না।
শুনে প্রীতি বললে, এবার বোধহয় জল দেবে। দেখছে, যখন উঠেই যাবে…
কিন্তু না। উপরন্তু মাঝেমাঝেই, সিঁড়িতে ওঠানামার সময়, ডেকে জিগ্যেস করেন।–কদ্দূর কি হল? দিন ঠিক করেছ কিছু?
সে আরেক যন্ত্রণা। দরজাটা একদিন শব্দ করে বন্ধ করে দিয়ে ধ্রুব রাগের গলায় বললে, শালা!
বাড়িটা তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
ধ্রুব প্রীতিকে বললে, দেখো, ছোটমাসি এলে যেন বলে বসোনা বাড়ি হয়ে এসেছে। শেষে যদি নীচের তলাটা ভাড়া চেয়ে বসে…
প্রীতি বললে, ছোটমাসিরা তো বাড়ি পেয়ে গেছে, অবশ্য অনেক দূরে, ছশো টাকা নাকি ভাড়া।
ধ্রুব বললে, তা হোক, তবু কি জানি, যদি বলে বসে। বরং সে কথা তুললে বলে দেবে ভাড়া হয়ে গেছে।
প্রীতি সায় দিল। —ঠিক বলেছ।
তারপর একটু থেমে বললে, নীচের তলাটা কিন্তু ভাড়া দিতে হবে। তা হলে তাড়াতাড়ি জগন্নাথবাবুর ধার শোধ হয়ে যাবে।
ধ্রুব বললে, তা বলে আজেবাজে কাউকে দেওয়া যাবে না। শুধু কোম্পানি লীজ। একজন বলছিল হাজার টাকা ভাড়া হবে।
প্রীতি বলে উঠল, বাঃ শুধু ভাড়া? অ্যাডভান্স নেবে না?
খুব মাথা নাড়ল। দেখি।
পাওয়া যাবে না মানে? দাদা তো বলেছিল, মাড়োয়ারিকে দিলে তিরিশ চল্লিশ হাজারও পেয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়।
–সত্যি! খুব খুশি খুশি মুখে ধ্রুব বললে।
প্রীতি যেন একটা আশার কথা শোনাল। ঠিক বিশ্বাস হল না, তবু শুনতেও ভাল লাগল।
এখন তো ধ্রুব একদিক থেকে নিশ্চিন্ত। আর কয়েকটা মাস, তখন আর নিজেকে নিরাশ্রয় মনে হবে না। কিন্তু ঘাড়ের ওপর একরাশ দেনা। অবশ্য জগন্নাথবাবুর কাছে যা বাকি আছে সেটা নিয়েই চিন্তা। বাকি সবই তো মাইনে থেকে কেটে নেবে। কেটে নিচ্ছে। এরপর বাড়িভাড়াটাও দিতে হবে না। হয়তো দুএক বছর একটু কষ্টেসৃষ্টে চালাতে হবে।
একটা ইচ্ছে ছিল, বাড়ি করবে শুধু নিজে থাকার জন্যে। ভাড়া দেবে না। বাড়িওয়ালা হবে না। তাছাড়া ভাড়াটে নিয়ে তো ঢের অশান্তি। তবু পাকেচক্রে, টাকার টানাটানিতে, কিছুটা হয়তো লোভ, এখন ভাড়া দেওয়ার কথা ভাবতে হচ্ছে।
একটাই সান্ত্বনা, এখন আর নিজেকে নিরাশ্রয় মনে হয় না।
নিরাশ্রয়। কথাটা ভাবতে গিয়ে হাসি পেল। একটা বাড়িই কি মানুষের আশ্রয়? শুধু কখানা ঘর? হয়তো তাই। এই সমাজে, এই সমাজব্যবস্থায়। তা না হলে আজকের মানুষের সমস্ত জীবনটাই অতৃপ্ত, অসুখী কেন, শুধু একটা আশ্রয়ের খোঁজে। কেউ ভাড়ার ফ্ল্যাট খুঁজছে, কেউ তা পেয়েও উদ্বেগ কিংবা অশান্তি নিয়ে টিকে আছে। একদিন ভারী জল দিতে না এলেই চক্ষুস্থির, হন্যে হয়ে তাদের খুঁজে বেড়াতে হয়। আর ধ্রুবর মতো যারা একটা কিছু করে ফেলেছে, তারাও তো ভাবছে সব কর্তব্য শেষ হয়ে গেল। যেন জীবনে একটা ফ্ল্যাট কিংবা বাড়ি করা ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। এই টাকায় গড়া সমাজ মানুষের জীবনের কাছ থেকে যেন আর কিছু চায় না। আর কোনও চাহিদা নেই। তোমার সমস্ত কিছু বিষয়বুদ্ধির কাছে বিকিয়ে দিয়ে যদি কিছু উদ্বৃত্ত থাকে, রুচি ও শিল্পবোধ, তা হলে একটা আর্ট ফিল্ম দেখে এসো, সম্ভব হলে গরিব কিংবা হরিজনদের সম্পর্কে। ছবিটা তোমার ভালই লাগবে, কারণ যারা তুলেছে, বিশ্বজোড়া নাম, তারাও ভাড়াটে। এতটুকু বিষয়বুদ্ধি নেই যে, সময় থাকতে একটা ফ্ল্যাট কিংবা বাড়ি করে ফেলবে।
ধ্রুব দৈবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। দৈব না থাকলে ওর পক্ষে এই বয়েসে কি একটা বাড়ি করে ফেলা সম্ভব হত। পিসেমশাই বেকায়দায় পড়ে হঠাৎ দুকাঠা জমি সেই বায়নার দরে দিতে চাইবেন কেন! তিন বছর আগেকার দাম। ভাবাই যায় না, ফ্ল্যাট কিনে ফেলে পাঁচ কাঠা জমি কেনার টাকাই ছিল না ওঁর হাতে।
তার ওপর এই জগন্নাথবাবু। দোতলাটা করে দিচ্ছি, আপনি সুবিধেমতো শোধ দেবেন।
কোত্থেকে কীভাবে যেন হয়ে গেল।
কিন্তু এখন আর দৈব মনে হচ্ছে না ধ্রুবর।
–কি ভাগ্য রে তোর, এই বয়েসে একটা বাড়ি করে ফেললি। তোর মেসো সারাজীবন চাকরি করে কিছুই করতে পারল না।
একটু থেমে বললে, আগে রিটায়ার করে লোকে বাড়ি করার কথা ভাবত। তাও পারত। তোরা আজকাল অনেক চালাকচতুর। কত কম বয়েসে সব করে ফেলছিস।
ছোটমাসি খবর পেয়েই একদিন চলে এসেছিল।
ধ্রুব হাসতে হাসতে বললে, দেনায় চুল পর্যন্ত ড়ুবে আছে, তোমরা শুধু ভাগ্যই দেখছ।
ছোটমাসি হাসল, বিশ্বাসই করল না।
তারপর বললে, নীচের তলাটা কি ভাড়া দিবি নাকি?
ধ্রুব চটপট বললে, ও তো ভাড়া হয়ে গেছে, অ্যাডভান্সের টাকা নিয়েই বাড়ি।
ছোটমাসি হতাশ গলায় বললে, অ্যাডভান্স না হয় আমরাই দিতাম, বললি না কেন?