সত্যি সত্যি বাড়ি শুরু হয়ে গেল। শুধু জগন্নাথবাবুর পরামর্শে নানা জায়গায় একটু ছোটাছুটি করতে হল ধ্রুবকে। কিন্তু সেটুকু এখন আর বিরক্তিকর নয়। বাড়ি হবে, নিজের বাড়ি। এর চেয়ে আনন্দের ব্যাপার যেন আর কিছু নেই। ভিত পুজো হল, ভিত খোঁড়া হল, বাড়ি উঠতে শুরু করল।
ধ্রুব প্রায়ই যায়, দেখে আসে। ও একা গেলে প্রীতি অনুযোগ করে। প্রীতিকেও তাই প্রায়ই সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়।
এ যেন এক ধরনের নেশা। চোখের সামনে দেয়াল উঠছে, কংক্রিট ঢালাই হচ্ছে। বহুদিনের একটা স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।
যেদিন প্ল্যান স্যাংশন হয়ে এসেছিল, কাগজের ওপর আঁকা নকশাটায় চোখ রেখে ও কল্পনায় যেন বাড়িটা দেখতে পেয়েছিল। এখন সেটা আরো স্পষ্ট রূপ নিচ্ছে। ইটের ওপর ইট গাঁথা হচ্ছে, আর কি অধৈর্য লাগতো ধ্রুব আর প্রীতির। মনে হত যেন বড় বেশি সময় লাগছে। যেন রাতারাতি বাড়িটা তৈরি হয়ে যাবার কথা!
ধ্রুবর ইচ্ছে ছিল একতলায় দুখানা ঘর। আপাতত ওইটুকুই। প্রীতি অবশ্য রান্নাঘর সম্বন্ধে কি সব ফরমাশ করেছিল। কোথায় শেলফ হবে, কোথায় গ্যাস সিলিন্ডার থাকবে।
জগন্নাথবাবু হেসে ফেলে বলেছেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে।
দেখতে দেখতে ছাদ পর্যন্ত হয়ে গেল।
কিন্তু জগন্নাথবাবু থামতে চাইলেন না। বললেন, প্ল্যান তো তিনতলা অবধি স্যাংশন হয়ে আছে, এখন অন্তত দোতলা অবধি করে দিই।
ধ্রুব ভয় পেয়ে গেল। হতাশ গলায় বললে, যা কিছু ছিল, যেখানে যা লোন পাবার সবই তো পেয়ে গেছি। আর তো কোথাও কিছু পাব না জগন্নাথবাবু। আমার ওই একতলাই ভাল।
জগন্নাথবাবু বলে বসলেন, আপনাকে এখন টাকা দিতে হবে না। আপনি যখন যেমন পারবেন দিয়ে দেবেন। হাসলেন উনি।
পিসেমশাই একদিন বাড়িটা দেখতে গিয়েছিলেন। সব শুনে বললেন, তুমি তো ভাগ্যবান হে, নিজের টাকায় দোতলাটা করে দেবেন।
প্রীতি তো শুনে অবাক। ধ্রুবর মনে হল জগন্নাথবাবুর মতো মানুষ হয় না। প্রীতি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললে, ভগবান, ভগবান।
শুধু পিসিমা বললেন, আমাদের বাড়িটাও এই সময় করে নিলে হত। টাকাগুলো সব ফ্ল্যাট কিনে আটকে গেছে, তা না হলে…
তারপরই রহস্যটা ফাঁস করলেন। বললেন, এ রকম বাড়ি আরো দু-চারটে করে দিচ্ছেন উনি। দিব্যি সুযোগ ছিল।
ধ্রুব বুঝতে পারল না। ওর কাছে ব্যাপারটা সত্যি এক রহস্য। নিজের টাকায় দোতলা করে দিচ্ছেন। কেন কে জানে।
পিসিমা হেসে বললেন, বড় কন্ট্রাক্ট পেয়েছেন গভর্নমেন্টের। বুঝতে পারছিস না? সব সেখান থেকে এখানে পাচার করছেন। পকেটের টাকা তো নয়।
কথাটা শুনেই ধ্রুবর চোখে জগন্নাথবাবু ভগবানের আসন থেকে একেবারে নীচে পড়ে গেলেন। তা হোক। ওর দোতলা তো উঠছে।
এতকাল এ সব কাজ ও ঘৃণা করেছে। অন্যায় মনে হয়েছে।
একদিন বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে রাখালবাবু সম্পর্কে বলেছিল, কালো টাকায় তো মশাই বাড়ি বানিয়েছে, পাপের টাকায়, এখন বাড়িওয়ালা বনে গেছে।
এখন আর ধ্রুবর অন্যায় মনে হচ্ছে না। মনকে বোঝাল, আমি তো অন্যায় কবছি। জগন্নাথবাবু কোত্থেকে কী আনছেন আমার জানার কথা নয়। আমি টাকা দিয়েই খালাস।
দেখতে দেখতে দোতলা উঠে গেল। সামনে ছোট্ট এক টুকরো ব্যালকনি বের করে দিয়েছেন জগন্নাথবাবু।
শুধু রঙ করা বাকি। সে পরে করা যাবে। জগন্নাথবাবুই করে দেবেন বলেছেন। অথাৎ ওঁর সরকারি কন্ট্রাক্টের বাড়ি এখনও হয়তো শেষ হয়নি। শেষ হলে রঙ করার সময় রঙ করিয়ে দেবেন।
কথাটা কীভাবে যেন রাখালবাবুর কানে পৌঁছে গিয়েছিল। কীভাবে আর, কাজের লোকের মারফত।
ইদানীং তো ওর আর প্রীতির মধ্যে আর কোনও কথাই ছিল না। শুধু বাড়ি আর বাড়ি। আর কতদিন লাগবে। জানালার গ্রীল যেন সুন্দর হয়।
ঠিকে ঝি বাসন মাজতে মাজতে নিশ্চয় শুনেছে।
রাখালবাবুকে এড়িয়ে এড়িয়েই চলত ধ্রুব। কথা বলতেও ইচ্ছে করত না। লোকটা জল বন্ধ করে দিয়েছে, ভারীর কাছ থেকে জল নিতে হয়। এদিকে পাম্প দিব্যি চলছে দুবেলা, শুধু নিজেই নেন।
লোকটার চক্ষুলজ্জাও নেই। একবার বলতে গিয়েছিল, উত্তর এল, এত অসুবিধে যখন, ছেড়ে দিলেই তো পারো। জল নেই, জল নেই, কপোরেশন দিচ্ছে না তো আমি দেব কোত্থেকে।
সারা শরীর জ্বলে উঠেছিল ধ্রুবর।
এই লোকের সঙ্গে দেখা হলে দিব্যি হেসে হেসে কথা বলতে হবে। তার চেয়ে এড়িয়ে যাওয়াই ভাল।
অবিনাশ অবশ্য বলেছিল, ও তোমার রাখালবাবুকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সব বাড়িওয়ালা একই ডিজাইনের ভাই, একই প্যাটার্ন। দু-চার জন শুধু আমাদের সুনন্দর মতো।
ভারীকে দিয়ে জল আনিয়ে জলের সমস্যা মেটানো যায়। একটু খরচ বাড়ে। ধ্রুব প্রীতিকে বুঝিয়েছিল, কত আর খরচ, একশো দেড়শো। দেড়শো টাকা বেশি দিলেও এ তল্লাটে কোথাও আর এরকম ফ্ল্যাট পাবে নাকি।
প্রীতিকে বোঝানো যায়, নিজেকে নয়।
এই ভারীকে দিয়ে জল আনানোয় বড় সম্মানে লাগে।
প্রথম প্রথম কি অস্বস্তি। সকালের দিকে বন্ধুবান্ধব কি আপিসের কেউ এসে পড়লে ভয়ে তটস্থ, যদি দেখে ফেলে।
উপেন থাকে চক্রবেড়িয়ায়। একদিন সকালে চলে এসেছিল কি একটা কাজে। ভারী তখন এক ভার জল নিয়ে গেছে, আবার আসবে। কাঁধে বাঁক লোকটাকে যদি দেখে ফেলে, কি আতঙ্ক। পর্দা টেনে যদি বা আড়াল করা যায়, দুদিকের কেরোসিন টিন থেকে জল উপছে পড়বে বারান্দায়। হয়তো কিছু জিগ্যেস করে বসবে উপেন। কি লজ্জা!
এখন পুরোনো হয়ে গেছে। ওসব লজ্জাটজ্জা নেই।