তাছাড়া রাস্তায় রাস্তায় ভারীরা তো খেয়ে পরে বাঁচছে। নতুন একটা প্রফেশন। আধুনিক কলকাতায় পুরনো একটা বৃত্তি। সেই সেকালের ভিস্তিওয়ালা এখন অন্য চেহারায়।
ল্যান্সডাউন রোডের চেহারাটা কি চমত্তার বদলে যাচ্ছে। দেখে গর্ব হয়। আমাদের কলকাতা। ঢাকুরিয়া ব্রিজের পাশে বিরাট সুপারমার্কেট হচ্ছে। দেখে তাক লেগে গেল ধ্রুবর। আঃ, কলকাতা বড় সুন্দর দেখতে হবে।
বাসের জানালা থেকে ঢাকুরিয়ার সুপারমার্কেট ঘেঁষে আকাশছোঁয়া বাড়িটা দেখতে দেখতে যোধপুর পার্কে পৌঁছে গেল।
ঠিকানাটা মনে নেই। কিন্তু পিসিমার গৃহপ্রবেশের দিন এসেছিল। অনেক লোেক, বহু আত্মীয়স্বজন। সবাই খুব প্রশংসা করছিল। দারুণ ফ্ল্যাট, দারুণ। পাশাপাশি দুখানা ফ্ল্যাট জুড়ে নিয়ে সে এক এলাহি কাণ্ড। কেটারার ডেকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা। খুব ভাল খাইয়েছিল পিসিমা। গোটা গোটা গলদা চিংড়ি আর মুর্গির ঠ্যাং।
পিসিমা বলেছিলেন, জমি বাড়ি কি ফ্ল্যাট যদি কিনতে চাস, তোর পিসেমশাইয়ের কাছে খবর পাবি। ও তো কম খোঁজেনি।
ধ্রুব সেজন্যেই চলে গেল একদিন। খুঁজে খুঁজে পেয়ে গেল।
বিশাল ফ্ল্যাট, খুব সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলেছেন।
ও তো বিজ্ঞাপন দেখে দেখে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে। কোথাও নাগালের বাইরে। বেশির ভাগই ফ্ল্যাটের সঙ্গে ঝামেলাও কিনতে হবে।
টাকাটাই মার যাবে কিনা স্থির নেই। কিংবা টাকা দিয়ে পাঁচ সাত বছর বসে থাকো।
পিসেমশাই সব শুনে বললেন, ফ্ল্যাটে সুখ নেই ধ্রুব, তার চেয়ে জমি কিনে বাড়ি করা ভাল। কিনবে জমি? আছে।
ধ্রুব বললে, সে তো অনেক টাকার ব্যাপার। আমি একটা ছোটখাটো ফ্ল্যাট কিনব ভাবছি। শুধু মাথা গোঁজার আশ্রয়।
পিসেমশাই বললেন, আমি তো ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেব ভাবছি।
একটু থেমে বললেন, একটা জমি আছে, পাঁচ কাঠা। বায়না করে রেখেছিলাম অনেক আগে। অ্যাদ্দিন ঝামেলা চলছিল। কিন্তু ফ্ল্যাট কিনে টাকা আটকে গেছে, দুকাঠা কেউ যদি নেয়…
দামটাম শুনল প্রীতি। দুদিন ধরে হিসেব কষা হল। ব্যাঙ্কে ইউনিটে কত আছে, অফিস থেকে কত লোন পাওয়া যাবে।
জায়গাটাও একদিন দেখে আসা হল। দিব্যি পছন্দ। একটু দূর, তা হোক।
একজন কারও ওপর নির্ভর করার মতো আনন্দ আর নেই। পিসেমশাই চৌকোশ লোক। ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
পিসেমশাই বললেন, ভালই হল, বাইরের কাউকে দিতে হল না। তুমি পাশে থাকবে সেও শান্তি।
বললেন, জমির জন্যে টাকা বায়না নিয়েই জমির মালিকটা মরে গেল, পাঁচজনের পরামর্শে বিধবা বৌটা আর বেচতেই চায় না। মামলা চলছিল, পাব কি পাব না ভেবে ফ্ল্যাট কিনে ফেললাম। এখন রায় বেরিয়েছে, এক মাসের মধ্যে পুরো টাকা দিয়ে কিনে ফেলতে হবে। তুমি ঠিক সময়েই এসে গেছ ধ্রুব।
কীভাবে এত টাকার ড্রাফট করাতে হয় ধ্রুব জানত না। ছোটাছুটি করে সমস্ত টাকা একটা অ্যাকাউন্টে এনে যেদিন ড্রাফট নিয়ে দিতে যাবে, বেশ ভয়-ভয় করছিল। একটাই ভরসা, পিসেমশাই সঙ্গে ছিলেন।
কেনা হয়ে গেল। অবশ্য ভাল দিকটাই পিসেমশাই তিন কাঠা নিয়ে নিলেন। তা হোক।
তখন রাতে ভাল ঘুম হত না ধ্রুবর। আনন্দে।
ওর স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। একটা বাড়ি। ছোট ছোট দুখানা ঘর, ব্যস আর কিছু চাই না।
কিনবে বলে যখন প্রায় ঠিক করে ফেলেছে, অফিসে অবিনাশকে বলল। অবিনাশ খুব উৎসাহ দিল, যেন তার নিজেরই বাড়ি হচ্ছে, এমন খুশি দেখাল ওকে।
–করে ফেল ধ্রুব, করে ফেল। ও শুরু করলে কি করে যেন হয়ে যায়।
সেদিনই চলে গিয়েছিল হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে। ভিতরে ভিতরে এমন একটা আনন্দ হচ্ছিল চেপে রাখতে পারছিল না।
বাবা সব শুনে খুশি হলেন, তবু বললেন, দেখেশুনে কিনবি।
মা আরও খুশি। বড়বৌদি শুনে বললে, যাক্, তোমার হলেও সুখ। আমাদের তো আর হবে না, ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেছে, তাদের পড়ার খরচ…
মেজবৌদিও খুব খুশি।–ধ্রুবদা করে ফেল, তোমার দাদাদের দেখিয়ে দাও, ইচ্ছে থাকলে করা যায়।
এমন যে হবে ধ্রুব ভাবতেও পারেনি। সেজন্যেই মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয় ঈশ্বর আছেন। অন্তত যাদের বাড়িঘর হয়, টাকাপয়সা হয়, নানাদিকে সাফল্য, তাদের নিশ্চয়ই ঈশ্বর আছেন। না, যাদের কিছুই নেই তাদেরও সেই ঈশ্বরই ভরসা।
খুব দৈবে বিশ্বাস করত না, কিন্তু ওরও মনে হল দৈব বলে কিছু থাকলেও থাকতে পারে। তা না হলে জগন্নাথবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়ে যাবে কেন। জগনাথবাবু এসেছিলেন পিসেমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে কি একটা কাজে। উনি বড় কন্ট্রাক্টর।
ধ্রুব নিজে দেখাশোনা করে বাড়ি করবে তা তো সম্ভব নয়। এসবের ও কিই বা বোঝে।
পিসেমশাই হাসতে হাসতে বললেন, কি ধ্রুব, এখনই বাড়ি শুরু করে দেবে নাকি?
কে জানে কেন, ধ্রুবকে ভাল লেগে গেল জগন্নাথবাবুর। বললেন, করতে হলে এখনই করে ফেলুন, এরপরে আর পারবেন না। হু হু করে দাম বাড়ছে জিনিসপত্রের।
ধ্রুব সঙ্কোচের সঙ্গে বলেছে, বাড়ি বলবেন না, পারলে শুধু দুখানা ঘর, মাথা গোঁজার মতো।
জগন্নাথবাবু বললেন, আমি একজন বিশ্বাসী লোক দিয়ে দেব, কম খরচে করিয়ে দেব।
হেসে বললেন, ভয় নেই, আমি মাঝে মাঝে দেখে আসব।
জগন্নাথবাবু রীতিমত বড় কন্ট্রাক্টর, বেশির ভাগই সরকারি কাজ। পাঁচ-সাতখানা। মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিংও বানিয়েছেন।
ধ্রুব তাই ভয় পেয়ে বললে, না না, আমি একেবারে সাদাসিধে ছোট্ট একটা বাড়ি করব। অত টাকা কোথায়? ধারধোর করে…।
জগন্নাথবাবু একটা কার্ড বের করে দিলেন ধ্রুবকে। বললেন, কত টাকা জোগাড় করতে পারবেন হিসেব করে, একদিন চলে আসুন। বাকিটা আমার দায়িত্ব।