ধ্রুব কোনও উত্তর দিতে পারেনি। ও ঝঞ্জাট এড়িয়ে চলতে চায়। তাছাড়া ও তো স্বপ্ন দেখছে, সুন্দর একটা ফ্ল্যাট কিনবে। নিজস্ব ফ্ল্যাট হবে। বাড়িওয়ালাকে ভাড়ার টাকা দেবার সময় যে হীনম্মন্যতায় ভোগে, তা আর ভুগতে হবে না।
কিন্তু কিন্তু করে বলেছে, লোভ হওয়া তো স্বাভাবিক, বঙ্কিমবাবু। পাশের ওই বাড়ির ফ্ল্যাট খালি হল, একেবারে হাজার পেয়ে গেল। শুনলে কোন বাড়িওয়ালার না লোভ হয়।
-পেলেই যদি নিতে হবে, তা হলে ব্ল্যাকমার্কেটিয়ারকে গালাগাল দেন কেন? ঘুষখোরকে গালাগাল দেন কেন? ওরাও তো পায় বলেই নেয়। সোজাসুজি না পেলে বাড়িওয়ালাদের মতোই প্যাঁচ কষে আদায় করে।
ধ্রুব আর কোনও কথা বলেনি, বরং রাখালবাবু সম্পর্কে দুটো কটুক্তি করেছে। পাছে ইউনিটি নষ্ট হয়ে যায়।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে ফ্ল্যাটের খোঁজ করেছে।
ওর মনের মধ্যে সব সময়েই একটা উদ্বেগ। ফ্ল্যাট কেনার আগেই না রাখালবাবু কিছু একটা করে বসেন। মামলাটামলা। কে তখন ছোটাছুটি করবে। অবশ্য বিশ্বস্ত ভাল উকিল ওর চেনা আছে। বাধ্য হলে তখন বঙ্কিমবাবুর মতোই লড়তে হবে। কিন্তু কে ওসব ঝুটঝামেলা চায়। তার ওপর ওই সদর দরজায় চাবি দেওয়া। একটা ড়ুপ্লিকেট চেয়েও পায়নি। আর গোঁপওয়ালা দারোয়ানটা দশটা বাজতে না বাজতেই চাবি দিয়ে এক-একদিন ছাদে চলে যায়। কেউ বেড়াতে এলে ধ্রুবকে ঘড়ির দিকে চোখ রাখতে হয়, নিজেকেই হাসতে হাসতে বলতে হয়, আসুন এবার। কারণ হাঁকাহাঁকি করে ও ব্যাটাকে ছাদ থেকে নীচে নামাতে আধ ঘণ্টা লেগে যাবে। বড় অপমান লাগে।
সব কারসাজি, সব কারসাজি।
আর এইসব ছোটখাটো ব্যাপারের জন্যে নিজেকে বড় নিরাশ্রয় লাগে।
ছোটমাসির দুভাবনা ও এখন বুঝতে পারছে।
এই সময়েই সেই দৃশ্যটা দেখল। দেখার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল।
হনহন করে হেঁটেই আসছিল। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।
এই গলিটা দিয়েই বাড়ি ফেরে ও। বকুলবাগানের দিকে যেতে হলে পথ সংক্ষেপ হয়।
দৃশ্যটা ওকে চুম্বকের মত টানল। দেখল রাস্তার অর্ধেক জুড়ে তূপীকৃত হয়ে পড়ে আছে একটি সংসারের যাবতীয় আসবাবপত্র। কেউ যেন ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যে ছুড়ে ছুড়ে বের করে দিয়েছে।
খাট, আলমারি, ড্রেসিংটেবল, বুককেস। ত্রিভঙ্গ হয়ে পড়ে আছে নারকেল ছোবড়ার পুরু গদি। তার চারপাশ ঘিরে বালতি, মদ, হাঁড়িকুড়ি, রাশি রাশি মশলাপাতির কৌটো। একটা পুরোেনো টিন টলে পড়েছে, তা থেকে গড়িয়ে পড়ছে সরষের তেল।
বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল। ধ্রুবর মুখ অজানা আতঙ্কে সাদা হয়ে গেছে।
অস্ফুটে বলে উঠল, ইস।
হঠাৎ নজরে পড়ল এক কোণে একটা তোলা উনোন, কেউ জ্বলন্ত উনোনে জল ঢেলে দিয়েছে। রান্নাও শেষ করতে দেয়নি, খাওয়ার কথাই ওঠে না। এক পাশে কড়াইয়ে আধরান্না কোনও একটা তরকারি, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িটা কাত হয়ে পড়ে আছে, তা থেকে ভাত গড়িয়ে পড়েছে ফুটপাথে।
প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকানো ছেলেটি বলে উঠল, শালা ছোটলোক, রান্না ভাতটুকুও খেতে দেয়নি।
ধ্রুবর চোখে পড়ল কিছুটা দূরে একজন ভদ্রমহিলা, সঙ্গে দুটি বাচ্চা ছেলে, একটি ফ্রক পরা মেয়ে। ভদ্রমহিলা মুখ নিচু করে আছেন। লজ্জায়, অপমানে।
ভদ্রলোক নেই। হয়তো তাড়াতাড়ি কোথাও কিছু একটা ব্যবস্থার খোঁজে বেরিয়ে গেছেন।
কে একজন বললে, ইজেক্টমেন্ট।
কথাটা শুনেই যেন শিউরে উঠল ধ্রুব।
মনে পড়ে গেল ছোটমাসির কথা।–তোর ছোটমেসো বলছে উকিল ড়ুবিয়েছে, উকিল বলছে তোর ছোটমসো ড়ুবিয়েছে। ছোটমাসির গলার স্বর কাঁদো কাঁদো। একটা ফ্ল্যাট কোথাও দেখে দে না।
ওই নিরাশ্রয় অচেনা লোকটার জন্যে বুকের ভিতরটা হা-হুতাশ করে উঠছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি নিজের জন্যে অজানা আতঙ্ক।
মনে পড়ে গেল বঙ্কিমবাবুর নামে উচ্ছেদের নোটিশ এসেছে।
কে যেন বলেছিল, আইন-আদালত ওই খাতায়-কলমে।
নিরাশ্রয়, নিরাশ্রয়। এই শহরের বেশিরভাগ মানুষ নিতান্তই নিরাশ্রয়। একটা অজানা আতঙ্ক নিয়ে বাস করে। বাড়িওয়ালার মেজাজ-মর্জির ওপর নির্ভর করে।
আইন আছে। আইন তো অনেকরকমই আছে। আইনের বই দেখলে মনে হবে এ দেশের প্রতিটি মানুষ কত নিশ্চিন্ত, সুখী। কারও কিছু ভয় পাওয়ার নেই। শুধু অফিস কামাই করে উকিলের কাছে, কোর্টঘরে ছুটে বেড়াতে পারলেই হল। শুধু টাকার জোরে ভাল উকিল জোগাড় করো। তাতেও নিশ্চিন্ত হতে পারবে না।
ওই অচেনা অজানা লোকটা স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোথায় যাবে ভেবে কোনও কুলকিনারা পেল না ধ্রুব। তার সঙ্গে ওই গোটা সংসারের আসবাবপত্র।
ধ্রুব একটা বাড়ি করার স্বপ্ন দেখছে বেশ কিছুদিন থেকে। অন্তত একটা ফ্ল্যাট। প্রচণ্ড ঘৃণার সঙ্গে ও মনে মনে উচ্চারণ করল, আমি আশ্রয় খুঁজব। শুধু নিজের জন্যে। হয়তো বাড়ির মালিক হব, কিন্তু বাড়িওয়ালা হব না। ভাড়াটের সুখ স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে শুধু কিছু টাকার লোভে নির্দয় বাড়িওয়ালা হবো না।
কিন্তু ওসব মহৎ সঙ্কল্প এখন থাক।
প্রীতি অনেককাল থেকে বলে আসছে, ও কান দেয়নি। কারণ কান দেবার মতো অবস্থা ওর ছিল না।
ছোটমাসি বলেছিল, তোর পিসিদের মতো তো টাকা নেই, মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, ফ্ল্যাট কিনব কোত্থেকে।
কজনেরই বা আছে। এখন চড়চড় করে যা ভাড়া বেড়ে গেছে। সেই ভাড়া দেবার মতো সঙ্গতিই বা কজনের।
সেসব চিন্তা করার কারও সময় নেই। পুরমন্ত্রী বলেছেন, জলের সাপ্লাই বাড়িয়ে দেব। সে জল কার ঘরে যাবে সে হিসেব রাখার কথা তাঁর নয়।