প্রীতির কাছে এসব কথা গোপন রাখতে পারবে না। ধ্রুবর যা স্বভাব, কোনও কথাই গোপন রাখতে পারে না। অথচ প্রীতিকে এই দৃশ্যটার কথা বললেই, ও জানে, প্রীতির মুখখানা নিমেষে বিবর্ণ হয়ে যাবে।
বাড়িতে ঢুকে ধ্রুব চুপচাপ শার্ট খুলল, প্যান্ট বদলে পাজামা পরল। কথাটা চেপে রাখার চেষ্টা করছে ও তখনও। যদি না বলে পারা যায়, প্রীতিকে অকারণ ভয় পাইয়ে দিয়ে কি লাভ। কিন্তু না বলেও পারছে না। কোনও একজনকে না বলে ফেলতে পারলে
ও নিজেই যে হাকা হতে পারবে না।
চেয়ারটা বেশ শব্দ করে টানল, রান্নাঘর থেকে প্রীতি যাতে শুনতে পায়। হয়তো জানেই না, খুব ফিরে এসেছে।
সকালের দিকে এই সময়টুকু ধ্রুব নিজে যত ব্যস্ত, প্রীতি তার হাজারগুণ। হাতের ঘড়িটা একবার দেখে নিল ধ্রুব।
খুট খাট ঠুং ঠাং শব্দ শোনা যাচ্ছে। কথাও। কখনও বালতি টানার কিংবা জল ঢালার শব্দ, কখনও হুঁড়ি কড়াই খুন্তির। এ সময় প্রীতির কাজ কি একটা। ঠিকে ঝি একদিকে, অন্যদিকে একজন রান্নার কাজের জন্যে–সুধা, তাদের ওপর নানারকম নির্দেশ দিতে দিতে প্রীতি নিজেও ছোটাছুটি করে কাজ করে। কি কাজ তা অবশ্য খুব ঠিক জানে না, জানার চেষ্টাও করে না। এ সময়টা সমস্ত বাড়িটার যেন এক জট পাকানো অবস্থা। এসব সময়ে ধ্রুব একটু দূরে সরে থাকতে চায়। এমন কি এক কাপ চায়ের কথা বলতেও দ্বিধা।
চায়ের কথা বলতে হল না। প্রীতির গলা শোনা গেল, সুধা দেখ, বোধহয় দাদাবাবু ফিরেছে, চা করে দে।
অথাৎ চেয়ার টানার শব্দটা ওর কানে গেছে।
যথা সময় চা এল। সুধাই নিয়ে এল।
চা খেতে খেতে খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিল ধ্রুব।
প্রীতি ঘরে ঢুকল কাপড় কাচার গুড়ো সাবানের প্যাকেট হাতে নিয়ে। বোধহয় রাখতে এসেছিল।
ধ্রুব কাগজ থেকে চোখ তুলে বললে, মন খারাপ হয়ে গেল আজ, একটা জিনিস দেখে।
কি দেখে এসেছে ও, বলতে গেল। জানো, আজ রাস্তায়, বিশুর পানের দোকানের পাশের রাস্তায়…
আরো একটু এগিয়েছে, বর্ণনা দিতে শুরু করেছে ও, শুনেই প্রীতি বলে উঠল, শুনেছি, কাজল বলছিল।
কাজল ওই ঠিকে ঝিয়ের নাম, ধ্রুব আন্দাজে বুঝে নিল। হয়তো এর আগে শুনেছে, মনে পড়ে গেল। আসলে ওই নামগুলো তো এক থাকে না, তিন মাস অন্তরই বদলে যায়। এত মনে রাখাও যায় না। যেমন ওই চব্বিশ ঘন্টার কাজের লোক সুধা। যাকে দিয়ে প্রীতি এখন রান্না করায়। ও নামটাও কতবার যে বদলে গেছে। র্যাশন কার্ডে ওরা সকলেই অবশ্য মীরা…পদবী কি মনে নেই। মান্ধাতা আমলে ওই নামের কেউ ছিল, সেই নামই চলে আসছে। বার বার নাম বদলানো তো সম্ভব নয়, ধ্রুব হাসতে হাসতে একবার বলেছিল, দুমাস অন্তর কার্ড বদলাতে গেলে তো মশাই গভর্নমেন্টই গণেশ ওল্টাবে।
ইনস্পেক্টর ভদ্রলোকও হেসে ফেলেছিলেন।
শুনেছি, কাজল বলেছিল। বাস, ওইটুকু বলেই প্রীতি চলে গেল।
আশ্চর্য, একটা কথা শোনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, সময় নেই ওর কথা বলার। এতই ব্যস্ত। বলবে তো কি শুনেছে? ঠিকে ঝিরাই তো পাড়ার গেজেট। সত্যিমিথ্যে মিশিয়ে নানারকম গুজব তো ওরাই ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়। তিলকে তাল বানায়। কথাটা মনে হতেই খুব ভাবল, আমরা ভদ্রলোকরাই বা কম কি। ওই ভাড়াটে ভদ্রলোককে নিয়ে এতক্ষণে বাড়িতে বাড়িতে কত গুজব রটে গেছে কে জানে।
কিন্তু কাজল কি শুনে এসেছে, কি বলেছে প্রীতিকে তা জানার কৌতূহল চেপে রাখতে পারছিল না ধ্রুব। এইসব সময়ে ও তাই মাঝে মাঝে প্রীতির ওপর চটে যায়। কাজ তো সকলেই করে, তা বলে দুটো কথা বলার সময় হবে না?
আর কিছুক্ষণ পরে ধ্রুবরও তাড়াহুড়ো। মান, খাওয়া, পোশাক বদলানো, এটা ওটার খোঁজ। লেটে অফিস যাওয়া।
অফিস যাওয়া মানে তো বিভীষিকা। যত দেরি হবে, তত ভিড় বাড়বে বাসে। লেটে গেলে তবু কিছুটা স্বস্তি। লেটে, অর্থাৎ সেই বারোটায়।
প্রীতি আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এল এতক্ষণে। এসেই বেশ রাগত স্বরে বললে, দেখলে তো। ঠাকুমা বলত, গরিবের কথা বাসী না হলে মিষ্টি হয় না।
ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হল না। ও তবু প্রীতির রাগ কমাবার জন্যে হেসে বললে, যা বাবা, আমি আবার বড়লোক হয়ে গেলাম কবে থেকে। আর আমি বড়লোক হলে তো তুমিও বড়লোক, গরিব হতে যাবে কোন দুঃখে।
উল্টো কাজ হল। মেয়েরা কথায় কথায় হাসে ঠিকই, কিন্তু ওদের সেন্স অফ হিউমার কম। ধ্রুবর রসিকতায় হেসে ফেলার বদলে প্রীতি প্রচণ্ড রেগে গেল।
বলে বসল, দেখবে দেখবে, যেদিন ওদের মতোই সব ঘর থেকে টেনে বের করে দেবে, সেদিন বুঝতে পারবে।
ধ্রুবর মুখ নিমেষে চুপসে গেল। এই একটা কথাই তো ও দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছিল। কোথায় সাহস দেবে, বলবে, তুলে দেওয়া অত সহজ নয়, আইন আছে তার বদলে…
খুব প্রতিবাদ করার বা হেসে উড়িয়ে দেবার জোর পেল না। তাই ধীরে ধীরে জিগ্যেস করল, কাজল কি বলেছে? কি করে তুলে দিল?
কি করে আবার। কাজল বলছিল, ভদ্রলোক নাকি ভীষণ ভালমানুষ, সবাইকে বিশ্বাস করেছিল…।
একটু থেমে বেশ রাগের স্বরে আবার বললে, ভালমানুষ হয়েই থাকো। ভালমানুষির আর দিন নেই, বুঝলে!
ধ্রুব আর কোনও কৌতূহল দেখায়নি, আর কোনও প্রশ্ন করেনি। কৌতূহল দেখিয়েই বা কি লাভ। কাজল তো বাসন মাজার ঠিকে ঝি। ঝি, ঠিকে ঝি বললে প্রীতি অবশ্য চটে যায়। ওর ভাষায় কাজের লোক। এখন বলে কাজল। এর আগেরটা ছিল লক্ষ্মীর মা। ধ্রুবর অতশত নাম মনে থাকে না।