সেদিন থেকেই ওটা বন্ধ হয়েছিল।
অন্যদিকে রাখালবাবুর সঙ্গে কতদিনের চেনা, পুরনো সম্পর্ক। কিছুই ভুলিনি, কিছুই ভুলিনি, বলে পঞ্চাশটা টাকা ফেরত দিয়েছিলেন। তখন কত ভালমানুষ।
এখন বুঝতে পারছে, বঙ্কিমবাবু অনেক আপন। কারণ ধ্রুব আর বঙ্কিমবাবু একই শ্ৰেণী। রাখালবাবুরা অন্য শ্ৰেণী। ওঁরা বাড়িওয়ালা। অর্থাৎ ওঁদের ভাড়াটে আছে। অথচ দু-চারজন ভাল বাড়িওয়ালার কথাও তো শুনেছে। আর যারা ভাড়াটাড়া দেয় না, বাড়ির মালিক, নিজেই থাকে, কই তারা তো এত খারাপ হয় না। নাকি তারা আবার আরেক চরিত্রের! একই মানুষ এক-এক পরিচয়ে এক-এক চরিত্রের মানুষ হয়ে ওঠে হয়তো।
বঙ্কিমবাবু চলে যাবার পরই কি মনে হতে আলমারি খুলে ভাড়ার রসিদগুলো দেখল খুব। কয়েক মাস আগে থেকেই খটকা লাগছিল। রেভিনিউ স্ট্যাম্পের ওপর সইটা যেন অন্য কার, আগের সইগুলোর সঙ্গে হুবহু মিল নেই।
বঙ্কিমবাবুকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়েছে জেনেই এক পরিচিত উকিলের কাছে ছুটে গিয়েছিল ধ্রুব।
সে তো প্রথমেই উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, তা হলে তো ফোজারির মামলা হবে। উপদেশ দিল, সামনে সই করতে বলবেন।
যেন এতই সহজ। সামনে সই করতে বললে তো রেগে টং হয়ে যাবে। তারপর কী করবে কে জানে। টাকা দেওয়ার পর বারবার মনে পড়াতে হয় রসিদ দেবার জন্যে। তার চেয়ে বড় কথা নিজেকে মনে রাখতে হয়। যেন টাকা নিয়েই তিনি ধ্রুবকে ধন্য করছেন।
অবশ্য দেখা গেল অন্য ভাড়াটের সঙ্গে রসিদের নম্বরের কোনও গরমিল নেই। উকিলবাবু বললেন, ওটাই যথেষ্ট প্রমাণ। দরকার হয় ভাড়াটেদের সাক্ষী ডাকবেন।
তারপর হাসতে হাসতে উকিলবাবু বললেন, ভাড়াটে তোলা যায় না মশাই, খোলা যায়। ঘাবড়াচ্ছেন কেন? মৌলালিতে আমার একটা বাড়ি আছে, মাত্র দেড়শো টাকা ভাড়া দেয়, নিজে উকিল হয়েও কিছুতেই তুলতে পারলাম না। পারব কি করে, নিজে তো থাকি না!
একটু থেমে বিষণ্ণ মুখে বললেন, অথচ তুলে দিতে পারলেই বেচে দিতাম। ভাল দামও পাওয়া যেত। স্রেফ ব্যাঙ্কে এফ ডি করে মাসে মাসে সুদ খাও। বাবা কেন যে বাড়ি করতে গিয়েছিল…
ধ্রুব কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করল। কিন্তু জলপথে যুদ্ধ নিয়েও থাকা যায় না। নিত্যদিন জল নিয়ে শান্তি। মাথা গরম হয়ে গিয়ে কখন যে কী করে বসবে ধ্রুবর সেও এক ভয়।
প্রীতি বললে, ওসব ছেড়ে দাও, একটা ফ্ল্যাট কেনার ব্যবস্থা করো, অন্তত মাথা গোঁজার জায়গা।
হেসে ফেলে বললে, কিছু চাই না, শুধু কল খুললেই জল চাই।
০৫. বকুলবাগানের এই এলাকাটা বেশ ছিমছাম
বকুলবাগানের এই এলাকাটা বেশ ছিমছাম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আশপাশের কয়েকটা বাড়ি একটু পুরোনো আমলের, কিন্তু বাড়ির মালিকরা কেউ দুঃস্থ নয়, দেয়ালের খসে পড়া পলেস্তারা মাঝে মাঝে সারানো হয়। কেউ কেউ বাইরের রঙও ফিরিয়েছে, সবুজ রঙ পড়েছে দরজা জানালায়।
এখানে অনেক সুবিধে। অফিস তেমন দূর নয়, একটুখানি হাঁটতে হয় ঠিকই, কিন্তু বাস-ট্রামের অভাব নেই। দোকানপাট, বাজার এমন কিছু দুরে নয়। এমন পাড়া ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু ঘরে যদি শান্তিই না থাকে, এ-সব সুখসুবিধে নিয়ে কি লাভ।
বঙ্কিমবাবু বাড়ি ছাড়ার নোটিশ পেয়ে প্রথমে বোধহয় একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। উনি তো ভয় পাবেনই, ওঁর নামেই নোটিশ। তাঁর সঙ্গে ধ্রুবর কোনও সম্পর্ক নেই, তবু সেও ধাক্কা খেয়েছিল।
অমিতবাবু বলেছিলেন, আমার তো মনে হয় ওয়ান বাই ওয়ান সকলের নামেই আসবে। আমাদের এখন ইউনাইটেড থাকতে হবে ধ্রুববাবু। বঙ্কিমবাবুর মামলা এখন আমাদের সকলের মামলা, একজোট হয়ে লড়তে হবে।
—ঠিকই বলেছেন। ধ্রুব মন্তব্য করেছে, ব্যাটা একজনকে ওঠাতে পারলেই একে একে সকলকে ওঠাবে।
বঙ্কিমবাবু শুনে সাহস পেয়েছেন। সেটুকুই বা কম কি। বলেছেন, আমার এখন তো উপায় নেই, দেয়ালে পিঠ দিয়েও আত্মরক্ষা করতে হবে।
কিন্তু মুখে যাই বলুক, ধ্রুবর নিজেকে বড় বিভ্রান্ত লেগেছে। এসব মামলা মকদ্দমা নিয়ে জড়িয়ে পড়া ওর একেবারেই পছন্দ নয়। সে আরেক অশান্তি।
তাছাড়া একটা ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন ও অনেকদিন থেকে দেখছে। প্রীতিও মাঝে মাঝেই তাগাদা দেয়। সময় থাকতে থাকতে কিছু একটা করে ফেল। এই ভো অনুপমদা কেমন একটা চমক্কার ফ্ল্যাট কিনে ফেলল। তোমার চেষ্টা নেই।
শুনে এতদিন বড় অসহায় আর অক্ষম লাগত। এখন তো অফিস থেকে লোন পাওয়া যাবে। ব্যাঙ্কেও কিছু জমেছে। বাকিটা মাসে মাসে ভাড়ার মতো কিস্তিতে শোধ করে দিলেই চলবে।
ধ্রুব বঙ্কিমবাবুকে বললে, ভাবছি একটা ফ্ল্যাট কিনব, আপনিও একটু খোঁজখবর রাখুন।
শুনেই হাসলেন বঙ্কিমবাবু। —আপনার তো টাকা আছে, তাই ও লাইনে ভাবছেন। আমার নেই। কলকাতায় কজন ভাড়াটের মশাই টাকা আছে, যে জল বন্ধ করলেই ফ্ল্যাট কিনে চলে যাবে। এ যুগে বাঁচতে হলে বাড়িওয়ালা যদি ঘোটলোক হয় আপনাকেও হতে হবে। তা না হলে বাঁচতে পারবেন না।
বঙ্কিমবাবু বেঁচে থাকাকে সত্যি সত্যি জীবনযুদ্ধ মনে করেন। মানিয়ে চলা বা হটে যাওয়ার পক্ষপাতী নন। একসিশটেন্সের সঙ্গে যে স্ট্রাগল কথাটা জড়িয়ে আছে উনি তা বিশ্বাস করেন। সেজন্যেই বলেছিলেন, পঞ্চাশটা টাকা আপনি এক কথায় বাড়িয়ে দিলেন? কত বাড়াবেন? তরতর করে বাড়িভাড়া বাড়ছে, হাজার দুহাজার, পারবেন পাল্লা দিতে? ও তো জানে তুলে দিতে পারলেই হাজার কি দেড় হাজার পাবে, আপনার পঞ্চাশে কি হবে ওর!