এর ওপর আবার নতুন ঝগড়া গোঁপওয়ালা দারোয়ানের সঙ্গে। কারণ সিঁড়িতে জল পড়লে ভারীকে ধমক লাগায় সে। একদিন নাকি ঢুকতে দেবে না বলে শাসিয়েছিল।
একদিকে রাখালবা। অন্যদিকে চার-চারজন ভাড়াটে। এক ভাড়াটের সঙ্গে অন্য বাড়ির ভাড়াটের দেখা হলেই ফিসফিস আলোচনা।—কি করা যায় বলুন তো। এক বাড়িওয়ালাকে আরেক বাড়িওয়ালা পরামর্শ দেয়। চাবি বন্ধ করে দিন, চাবি বন্ধ করে দিন।
অবিনাশ কথাটা ভালই বলেছিল। জলপথে যুদ্ধ।
শেষে বাড়ির মধ্যেই অশান্তি।
প্রীতির মেজাজ সব সময়েই সপ্তমে। কণ্ঠস্বরও।
কোথাও শান্তি নেই। পৃথিবীটাই যেন অগোছালো। এক অশান্তি থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যে আরেক অশান্তিতে ঝাঁপ দেওয়া। আলাদা ঘরসংসার করেও সুখ নেই।
ধ্রুবর এক একসময়ে মনে হয় বিয়ের আগের দিনগুলোই যেন ভাল ছিল।
দিনরাত সংসার সংসার, অফিস থেকে ফিরে ধ্রুবর হঠাৎ একদিন মনে হয়েছিল প্রীতির ওপর বড় অবিচার হচ্ছে, মাঝে মাঝে সেই পুরনো দিনে ফিরে যেতে পারলে মন্দ হয় না।
অফিস থেকে ফিরে একদিন বললে, বাইরে যাওয়া মানে তো সিনেমা আর দোকান, দোকান আর সিনেমা, চলো আজ একবার লেকে বেড়িয়ে আসি।
প্রীতি হেসে বললে, যাক তা হলে এখনও ইচ্ছে হয়!
লেকে বেড়াতে বেড়াতে ওরা একটা গাছের নীচে দিয়ে যখন চলেছে, নড়বড়ে পাযে টিপু হাঁটছে ধ্রুবর হাত ধরে, প্রীতি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বললে, এই, কিছু মনে পড়ে?
ধ্রুবর মনে পড়ছে না দেখে হেসে উঠল। প্রশ্ন করলে, কী গাছ বলো তো এটা?
ধ্রুবর মনে পড়ে গেল। বললে, সোঁদাল।
—ইস কি আনরোমান্টিক, অমলতাস বলতে পারো না!
দুজনেই হেসে উঠল। কারণ বিয়ের আগে ঠিক এই গাছটাকে নিয়ে এই কথাগুলোই হয়েছিল।
গাছের তলা দিয়ে যেতে যেতে ধ্রুব মৃদু হেসে বললে, গাছটা মনে থাকবে না? দ্য বিগিনিং।
প্রীতি হেসে বললে, এখন তো মনে হয় দি এন্ড।
ধ্রুব হাসল। এই গাছটার অন্ধকার মেখে যাবার সময়েই, সেই প্রথম সাহস করে ধ্রুব বলেছিল, আমি এবার একটা চুমু খাবো।
পায়ে সাপ জড়িয়ে গেছে এমনভাবে আতঙ্কে লাফিয়ে উঠেছিল প্রীতি। এই না, ন্না, ন্না।
ততক্ষণে প্রতিরোধ দুর্বল, প্রীতি স্থির।
ধ্রুবর বাঁ হাত প্রীতির কাঁধ বেষ্টন কবে সাপের মতোই তার কণ্ঠতট বেয়ে নেমে আসতে চাইছিল।
প্রীতি ঝট করে ধ্রুবর সরীসৃপ আঙুলগুলো মুঠোর মধ্যে ধরে জোরে মোচড় দিয়েছে।
–উফ। চিৎকার করে উঠেছে ধ্রুব।
ফেরার সময়ে ধ্রুবর অভিমানে থমথম মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আগেই সব শেষ করে দিলে বিয়ের পরে আর কি থাকবে!
লেকে আবার বেড়াতে গিয়ে সেই গাছটার তলা দিয়ে যেতে যেতে প্রীতি স্বগত উক্তিতে বললে, বিয়ের আগের দিনগুলোই ভাল ছিল। একটু থেমে বললে, সব সুখ কেড়ে নিল ওই রাখালবাবুটা। একটা ট্যাঙ্কের চাবি!
দুজনেই হেসে উঠল।
এমনি সময়েই হঠাৎ একটা সুখবর শুনল অফিসে এসেই। অনেকদিন ধরে কথাবার্তা চলছিল, সুরাহা হয়ে গেছে। অফিসের কো-অপারেটিভ থেকে মোটা টাকা লোন পাওয়া যাবে বাড়ি তৈরির জন্যে। ফ্ল্যাট কেনার জন্যেও।
সঙ্গে সঙ্গে ধ্রুবর মনে হল যেন ওর ফ্ল্যাট কেনা হয়ে গেছে। কিংবা একটা বাড়ি।
স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিল।
প্রীতিও শুনল। স্বপ্ন দেখল। সে কি উল্লাস।
এই সময়ে হঠাৎ একদিন বঙ্কিমবাবু বিশুষ্ক মুখ নিয়ে এসে হাজির হলেন। ধ্রুববাবু, আপনার সঙ্গে কথা ছিল।
ধ্রুব আসুন আসুন বলে তাঁকে নিয়ে গেল বসার ঘরে। কপাট বন্ধ করে দিল। একটাই তো আলোচনা এখন। একটাই বিষয়। বাড়িওয়ালা। সেজন্যে যখনই নিজেদের মধ্যে কোনও পরামর্শ হয়, বসার ঘরের কপাট বন্ধ করে দেয় ধ্রুব। রাখালবাবু বা তার ছেলেমেয়ে কেউ সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করার সময় না শুনতে পায়।
বঙ্কিমবাবু একখানা লম্বা খাম এগিয়ে দিলেন।
-কী ব্যাপার? ধ্রুব সন্ধিগ্ধ স্বরে জিগ্যেস করল।
বঙ্কিমবাবু বললেন, বাড়ি ছাড়ার নোটিস।
ধ্রুব চমকে উঠল।–সে কি?
বঙ্কিমবাবু বিষণ্ণ হাসি হাসলেন। —হ্যাঁ। কাল এসেছে রেজিষ্ট্রি ডাকে।
ধ্রুব সাহস জোগাতে চাইল। –ছেড়ে দাও বললেই ছেড়ে দিতে হবে, কি আন্দার। কোন গ্রাউন্ডে তুলবে শুনি!
বঙ্কিমবাবু হাসলেন।–মামলা করবে ভয় দেখাচ্ছে, মামলাকে আমি ভয় পাই না। আমাকেও তো আত্মরক্ষা করতে হবে ধ্রুববাবু, ও জানে না তখন আমার অন্য চেহারা দেখবে। তবে ওই, মামলা মকদ্দমার ঝামেলা কে চায় বলুন। কিন্তু উপায় তো নেই।
বঙ্কিমবাবু খবরটা জানিয়ে গেলেন। বললেন, ভাড়া দিতে গিয়েছিলাম, তাও নেয়নি। নেয়, রেন্ট কন্ট্রোলে দেব।
বলে চলে গেলেন।
আর সঙ্গে সঙ্গে ধ্রুব কেমন বিচলিত বোধ করল। বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে বিরোধ, ধ্রুবর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। ওর বিরুদ্ধে তো রাখালবাবু মামলা করতে যাচ্ছেন না। তবু মনে হল যেন ওরই বিরুদ্ধে। বঙ্কিমবাবুও তো একজন ভাড়াটে। সব ভাড়াটের স্বার্থ তো একসঙ্গে জড়িয়ে আছে।
ওর মনে হল বাইরের পরিচয়গুলো কিছুই নয়। বঙ্কিমবাবুকে ও চিনতও না। হয়তো ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে মন কষাকষিও হয়েছে কখনো-সখনো। বঙ্কিমবাবুরা সিঁড়ির প্যাসেজে বাড়িসুদ্ধ লোকের জুতো রাখতেন। ধ্রুব বলে বলেও বন্ধ করাতে পারেনি।
শেষে একদিন রেগে গিয়েই বলেছিল, এটা কমন প্যাসেজ, এভাবে এনক্রোচ করা চলে না। আমার বাড়িতে কেউ এলে সে সামনে জুতোগুলো দেখলে কি ভাববে বলুন তো। ভাববে আমিই রেখেছি।
বাগ সামলে নিয়ে হেসে বলেছিল, জুতো দেখিয়ে অভ্যর্থনা!