একজন অজ্ঞাতকুলশীল মানুষ, সে লোকটির মুখও দেখেনি ধ্রুব, কেমন চরিত্রের মানুষ, ভাল না মন্দ, কিছুই জানে না, তবু ওর বুকের মধ্যে আধখানা জুড়ে যেখানে আতঙ্ক শিকড় গেড়েছে, তারই পাশে অসহায় অচেনা মানুষটির জন্যে সমবেদনা উথলে উঠল।
ধ্রুব ধীরে ধীরে বললে, ওঁদের কেউ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসতে দিলেও তো পারত।
ধুতি পাঞ্জাবি পরা বৃদ্ধের কানে গেল কথাটা। তীব্র ব্যঙ্গের স্বরে বলে উঠলেন, বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসতে দেবে? পাড়ার কেউ আসেনি মশাই, কেউ আসেনি। শুধু দোতলা তিনতলা থেকে উকি দিয়েই সরে যাচ্ছে।
প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকানো ছেলেটি প্রতিবাদ করল।পাশের বাড়ির লোক তো ডাকতে এসেছিল, ওঁরাই যাননি।
ঠিক তখনই দেখা গেল, একটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে বছর আঠারো কুড়ির একটি মেয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়ানো ভদ্রমহিলার কাছে গেল। কিছু বলল। হাত ধরে ডাকল। ভদ্রমহিলা প্রথমটা না না করে শেষে ছেলেমেয়েদের নিয়ে তার সঙ্গে চলে গেলেন।
ওঁরা চলে যেতেই রাস্তায় পড়ে থাকা খাট, আলমারি, বুককেস, জল ঢালা তোলা উনোন, ভাত গড়িয়ে পড়া অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি রাস্তার একপাশে বিস্ময়ের, আতঙ্কের একটা বিশাল প্রশ্নচিহ্ন হয়ে পড়ে রইল।
একে একে সকলেই চলে যাচ্ছিল। ধ্রুব দেখল, ওরা কেউই পাড়ার লোক নয়। ধ্রুবর মতোই পথ দিয়ে যেতে যেতে হয়তো দাঁড়িয়ে পড়েছে।
ধ্রুবও চলে এল। কিন্তু দৃশ্যটা মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারল না।
লোকটি অচেনা। সরল নিরপরাধ শান্তশিষ্ট সংসারী মানুষ, না জটিল ধুরন্ধর প্রকৃতির, তাও জানে না। তবু, নিজেরই অজান্তে কি ভাবে যেন অদেখা মানুষটির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে।
পাড়ার কেউ এগিয়ে আসেনি। এসে থাকলেও দুএকজন। অথচ কেন? মানুষটি যত খারাপই হোক, এই দুঃসময়ে দুটো মুখের কথার সমবেদনা জানাবে না? বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে দুদণ্ড বসতে দেবে না? এই কৌতূহলী জনতার চোখের সামনে উপহাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?
ধ্রুব কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিল না। এটা যদি ধ্রুবরই পাড়ার ঘটনা হত, ও কি এগিয়ে যেত? বলত, আসুন আমাদের বাড়িতে? ছেলেমেয়েদের বলত, এসো। তোমাদের বাবা যতক্ষণ না ফিরে আসেন…
ধ্রুব বুঝতে পারল না।
এখন তো পাড়ার মধ্যে এরা অচ্ছুত হয়ে গেছে। লাঞ্ছিত, অপমানিত একটি মানুষের সঙ্গ থেকে সকলেই দূরে সরে থাকতে চায়। পাছে তার গায়েও সেই অপমানের ছিটে লাগে। না কি ভয়? এ রাস্তার বেশির ভাগই তো ভাড়াটে। দোতলা তিনতলা বাড়ির সারি। বাড়িওয়ালা ওপরে থাকেন। নীচের একতলা দোতলা ভাড়া দিয়েছেন। ভাড়াটেরা একা একা বাড়িওয়ালাকে তোয়াজ করে চলার চেষ্টা করে। উচ্ছেদ হওয়া ভাড়াটের পাশে এসে দাঁড়ালে বাড়িওয়ালা রুষ্ট হবে সেই ভয় থেকেই কি কেউ এসে দাঁড়ায়নি।
অসম্ভব। বাড়িওয়ালাকে আজকাল কেউ এত ভয় পায় নাকি?
আসলে তা নয়। ভদ্রমহিলাই হয়তো যেতে চাননি। ওঁর সর্বাঙ্গে তো এখন অসীম লজ্জা। দুদিন আগে যাদের সঙ্গে হেসে কথা বলেছেন, তাদের চোখের সামনে এই দৃশ্য। উনি চোখ তুলে তাদের দিকে তাকাবেন কি করে! সেজন্যেই যেতে চাননি। কেউ আর এগিয়ে আসেনি। শেষে রাস্তার লোকের ভিড় থেকে পালাবার জন্যেই মেয়েটির সঙ্গে যেতে রাজি হয়েছেন।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে ধ্রুব এইসব কথাই ভাবছিল। ওর হঠাৎ মনে হল, কি আশ্চর্য। লজ্জা কি শুধু ওই ভদ্রমহিলার? আমিও তো লজ্জিত অপমানিত বোধ করছি। আমাদের রাস্তায় এ-ঘটনা ঘটলে এ অপমান আমাকে আরো বেশি করে স্পর্শ করত। আমি রাস্তায় বেরিয়ে এসে ওদের কাছে যেতে পারতাম না। কেবলই মনে হত তিনতলার ব্যালকনিতে দাঁড়ানো বাড়িওয়ালার খুশি খুশি উপহাসের দৃষ্টি আমার পিঠের ওপর আছড়ে পড়ছে। এ তো প্রতিটি ভাড়াটের লজ্জা।
ধ্রুবর নিজেরই খুব অবাক লাগছিল। বাড়িওয়ালার সঙ্গে তো ওর এখনও মৌখিক সদ্ভাব আছে। অথচ ও এখন আলাদা মানুষ হয়ে যাচ্ছে কি করে। এই মুহূর্তে বাড়িওয়ালা মানুষটিকে ধ্রুব ওর বিপরীত দিকে দেখতে পাচ্ছে কেন!
সব দিক থেকে ওরা মিলেমিশে একই মানুষ। কোনও তফাত নেই। শুধু একজনের বাড়ি আছে, আরেকজনের নেই। শুধু সেজন্যেই ওরা আলাদা মানুষ হয়ে যাবে?
বকুলবাগানের এই বাড়িতে ঢোকার সময় অজান্তেই ওর চোখ চলে যায় ওপাশের তেতলার বারান্দায়। কেউ সেখানে না থাকলে নিশ্চিন্ত।
আসলে ধ্রুবরা এদিকের ফ্ল্যাটে ভাড়া আছে অনেকদিন। ওদিকটায় আরেক ভাড়াটে। বাড়িওয়ালা তো তেতলায়। ইদানীং ভদ্রলোকের সঙ্গে আর তেমন ভাব ভালবাসা নেই। হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে দুজনের মুখেই মিষ্টি হাসি দেখা যায়, দুচারটে অন্তরঙ্গ ভনিতা। তারপর ধ্রুবই ব্যস্ততা দেখিয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসে। কারণ ওর আশঙ্কা, আর কিছুক্ষণ সময় দিলেই রাখালবাবু কথাটা তুলবেন। সঙ্গে সঙ্গে সারাদিনের জন্যে মেজাজ নষ্ট হয়ে যাবে। ধ্রুব অবশ্য হেসে হেসেই কিছু একটা বলবে, স্তোক দেবে, হয়তো মিথ্যে স্তোক। কিংবা মুহূর্তে রেগে গিয়ে কিছু একটা বলে বসবে। তখন তার আবার কি প্রতিক্রিয়া হবে কে জানে!
সেজন্যেই ও তেতলার বারান্দার দিকে চোখ তুলে তাকায় না। চোখাচোখি হওয়াকেও ভয়। কতদিন তো রাস্তায় দূর থেকে রাখালবাবুকে আসতে দেখে ও ফুটপাথ পাল্টেছে।
কিন্তু আজ আর শুধু রাখালবাবুকেই ভয় নয়। ভয় প্রীতিকেও।
রাস্তার ওপর ছুড়ে ফেলে দেওয়া একটা গোটা সংসার, কয়েকটা অভুক্ত মানুষের সুকোনোমুখ, ব্যস, এই দৃশ্যটুকু দেখার পর থেকে ধ্রুবর মনে হচ্ছে ওর যেন হাঁটুতে কোনও জোর নেই। নিজেকে কেমন অসহায় লাগছে।