সেইজন্যেই হেমন্তবাবুর জন্যে ধ্রুবর দুঃখ হয়। আচ্ছা, উনি কি আবার সেই ধ্রুবদের মতোই ভাড়াটে হয়ে গেলেন! নাকি যা কিছু টাকা পয়সা পেয়েছেন, অনেক দূরে, শহরের বাইরে গিয়ে নতুন একটা বাড়ি করেছেন। কেউ জানে না।
বারান্দা থেকেই প্রীতি একদিন ডাকল, এই শোনো শোনো, দেখে যাও।
ধ্রুব টিপুকে নিয়ে খেলা করছিল। একটা খেলনা মোটরগাড়ি কিনে দিয়েছে টিপুকে। টিপুর আব্দারে সেটায় বারবার চাবি ঘুরিয়ে দম দিতে হচ্ছিল ওকে।
প্রীতি আবার ডাকল, এসো না, দেখে যাও, কি সুন্দর রঙ করছে।
ধ্রুব উঠে গেল। বাড়িটা তখন শেষ হয়ে এসেছে। গিয়ে দেখল, বাইরের দেয়ালে রঙ শুরু হয়েছে।
ধ্রুব দেখে বললে, বাঃ দারুণ লাগছে। খুব সুন্দর রঙ।
প্রীতি বললে, ওই পরের বাড়ির প্রশংসা করেই জীবনটা কেটে যাবে, নিজেদের তত কিছু হবে না।
ধ্রুব দমে গেল। এই একটা কথা শুনলেই ওর নিজেকে বড় অক্ষম লাগে। অসহায় লাগে।
বাবার কাছ থেকে আর কিছু পাওয়া যাবে না। আন্দাজে আন্দাজে যেটুকু বোঝে ধ্রুব, যা আছে বাবার—ওই পেনসান, তাতে তাঁর নিজের জীবনটা কেটে গেলেই যথেষ্ট। এত বড় পরিবারের জন্যে একটা বাড়ি করা সম্ভবও নয়। দাদা মেজদারা প্রায়ই এবাড়ির অসুবিধের কথা বলে। হয়তো কোনওদিন নিজেরাই ফ্ল্যাট কিনবে।
এদিকে বাড়িওয়ালাও প্রায়ই উঠে যাওয়ার কথা বলছে।
প্রীতি একদিন বললে, দেখো ফ্ল্যাট কেনাটেনার কথা ভেবে লাভ নেই, বরং একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে উঠে চল।
আসলে ধ্রুব নিজেই তো আর মানিয়ে চলতে পারছিল না। প্রীতি পারবে কি করে।
ও সব সময় একটা হীনম্মন্যতায় ভুগত। এবাড়ির বড়বৌ, মেজবৌ দুজনেই বাপের বাড়ি থেকে যথেষ্ট দানসামগ্রী নিয়ে এসেছে। প্রচুর গয়নাগাঁটি। এ বাজারের দরদামে হিসেব করলে অনেক টাকা। সে তুলনায় প্রীতি প্রায় কিছুই আনেনি। ওর বাবা অবশ্য সাধ্যের তুলনায় যথেষ্ট দিয়েছেন, কিন্তু প্রীতি জানে ওদের তুলনায় তা কিছুই নয়।
ওরা যখন জড়োয়া গয়নায় সেজে বিয়েবাড়িতে যায়, প্রীতি সঙ্গে যেতে চায় না।
সেজন্যে ওর লজ্জা, সেজন্যে ওর রাগ। মনে মনে ভাবে, মেয়েরা কি কোনওদিনই বদলাবে না! আসলে ছেলেরা না বদলালে মেয়েরাই বা বদলাবে কি করে।
কিন্তু এইসব থেকে ভিতরে ভিতরে একটু একটু করে বারুদ জমছিল। হঠাৎ একদিন বিস্ফোরণ ঘটল।
প্রীতি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলে বসল, আমি আর এবাড়িতে এক দণ্ডও থাকব না।
ধ্রুবও তার কথায় সায় দিল।–না, এক দণ্ডও না।
দপদপ করে পা ফেলে গিয়ে দাঁড়াল বাবার কাছে। বাবা সব শুনেছেন। শুনলেও উনি আজকাল চুপচাপ থাকেন। কারও হয়ে কোনও কথা বলেন না। উনি জানেন, এখন আর ওঁর কথার কোনও দাম নেই। ছেলেদের ওপর ওঁর আর কোনও জোর নেই। কারণ ছেলেরা সবাই এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে গেছে বলেই উনি সংসারের কাছে ফালতু মানুষ হয়ে গেছেন।
অথচ এই ছেলেরাই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে বলে বুকের ভিতরে একসময়ে কত গর্ব ছিল। গর্ব এখনও।
খবরের কাগজ থেকে চোখ না তুলেই বুঝতে পারলেন ধ্রুব এসেছে; কিছু বলতে চায়। তবু চোখ তুললেন না।
-বাবা!
-বল।
ধ্রুবর গলার স্বরে তখনও ক্রোধ উপছে পড়ছে। বললে, এই অশান্তি নিয়ে এবাড়িতে আর থাকা যায় না।
ধ্রুবর মা বারান্দার এক চিলতে রোদ্দুরে বড়ি শুকোতে দিচ্ছিলেন। ভুরু কুঁচকে একবার ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। বেশ রাগত স্বরে বললেন, অশান্তি তো তোরাই করছিস। সংসার তো এখন তোদের, শান্তি থাকলে তোদেরই, অশান্তি করলেও তোরাই।
—আমরা অশান্তি করছি? ধ্রুব আরো রেগে গেল।
মা বললেন, তোরা সবাই। সংসার যখন আমাদের ছিল, তখন তো এ-সব অশান্তি ছিল না।
ধ্রুবর বাবা এতক্ষণে কথা বললেন।—এসবের মধ্যে আমাদের আর টানছিস কেন! আমরা সাতেও নেই পাঁচেও নেই। দুবেলা দুটি খাই, আর কাজ তত নেই, পড়ে পড়ে ঘুমোই। বেঁচে থাকাটাই বিড়ম্বনা।
বাবার গলার স্বরে, বলার ধরনে, কি যেন ছিল। ধ্রুবর মন নরম হয়ে আসছিল। হয়তো রাগ পড়েও যেত।
তার আগেই প্রীতি এসে দাঁড়িয়েছে। আপনি বলছেন, এই সব অন্যায় সহ্য করে চলতে হবে!
ধ্রুবর বাবা মুখ না তুলেই বললেন, আমি কিছুই বলছি না। রিটায়ার্ড ম্যান, আমার আর বলার এক্তিয়ার কোথায়?
প্রীতি বলল, বাবা, এভাবে অশান্তি বাড়িয়ে কোনও লাভ নেই। বলে ধ্রুবকে চোখের ইশারা করল। অর্থাৎ যা বলতে এসেছিল বল।
ধ্রুব আবার উত্তেজিত হয়ে উঠল। বললে, আমরা উঠে যাচ্ছি। আমরা উঠে গেলেই তো ওরা শান্তি পাবে।
প্রীতি বললে, হ্যাঁ বাবা, আমরা চলেই যাব।
বাবা চোখ তুলে অবাক হয়ে তাকালেন ছেলের মুখের দিকে।
–চলে যাবি?
মাথা নীচু করলেন। একটু থেমে বললেন, যেতে চাস, যা। কেউ যেতে চাইলে কি আর ধরে রাখা যায়।
হঠাৎ হেসে ফেললেন। হাসিটা কান্নার মতো। বললেন, আমাদেরও তো যাবার সময় হয়ে এল।
ধ্রুব আর প্রীতি চলে এল। বাবার সামনে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না ধ্রুব।
ফিরে আসতেই বড়বৌদি বলে বসল, চলে যাবে সে তো ঠিক করেই রেখেছিলে, অজুহাত দেওয়ার দরকার কি ছিল।
ধ্রুব আরো রেগে গেল সে কথা শুনে। কোনও জবাব দিল না। কিন্তু চলে যাব বললেই তো চলে যাওয়া যায় না। কোথায় যাবে! তার আগে তো একটা ভাড়ার ফ্ল্যাট জোগাড় করতে হবে।
এই বাড়িটা যখন ভাড়া নিয়েছিল, তখন বাড়ির সামনে টু লেট ঝুলত। ভাড়াও কম। ভাড়া বাড়িয়ে বাড়িয়েও এখনও যথেষ্ট কম।
অফিসের বিনোদবাবু শুনে ধ্রুবকে বলেছিলেন, আপনি তো মশাই বিনা ভাড়ায় একটা গোটা বাড়ি নিয়ে আছেন। নতুন ভাড়াটেদের দুঃখ আপনি বুঝবেন না।