রাখালবাবু বললেন, এই শনিবারেই চাই কিন্তু ধ্রুব। বলে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করেছেন। সব লেখা আছে, দেখে নিও। ইস্কুলের নামটাম, উপমন্ত্রীকে কি বলতে হবে।
এ ধরনের কাজ কখনও করেনি ধ্রুব, জানেও না। তবু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতে হয়েছে।
কাজের দায়িত্বটা নিয়েই রাখালবাবু লোকটির ওপরই ও রেগে গেছে, বিরক্ত হয়েছে।
বাড়িতে ফিরেই রাগ গিয়ে পড়েছে বড়বৌদির ওপর।—দাদার কি দরকার ছিল লোকটাকে আমার পিছনে লেলিয়ে দেওয়ার। অত যদি দয়ামায়া, নিজে করে দিলেই তো পারত।
সব শুনে বড়বৌদিও রেগে গেছে। বলেছে, ওসব কথা আমাকে বলছ কেন, নিজের দাদাটিকে বললেই তো পার।
কিন্তু যত রাগই হোক ধ্রুবকে কাজটা করে দিতে হয়েছিল। রাত জেগে, তিন দিন ধরে সেটা ঘষামাজা করে একটা গুরুগম্ভীর স্তবের মতো করে লিখে দিয়েছিল।
শেষ হতেই প্রীতিকে বলেছিল, উপমন্ত্রীকে তৈলদান কমপ্লিট।
প্রীতি আধখানা পড়েই হেসে লুটোপুটি।
কিন্তু রাখালবাবু অভিনন্দন পত্রখানা পেয়েই একবার ভাঁজ খুললেন, ভাঁজ করলেন। তারপর পকেটে রেখে দিলেন। মুখে তৃপ্তির হাসি। পড়ে দেখলেনও না।
ব্যস, এটুকুই পরিচয়, এটুকুই উপকার।
ওই ব্যারাকের মতো বাড়িটাকে ওরা উপেক্ষাই করত। এমনকি ওই বাড়ির মালিক হেমন্তবাবুকেও এড়িয়ে এড়িয়ে চলত, যদিও মানুষটি ছিলেন খুবই সজ্জন, বিনয়ী ভদ্রলোক। ওঁর বিনয় হয়তো বা খানিকটা হতাশা থেকে, দারিদ্র্য থেকে। অথচ সত্যি তো দরিদ্র ছিলেন না। একটা বাড়ির মালিক। দরিদ্র হবেন কেন।
ধ্রুবদের ভাড়া বাড়িটা ছিল রীতিমত ভাল, বলতে গেলে একেবারে ঝকঝকে নতুন। আর হেমন্তবাবুর নিজের বাড়িটা ধসে পড়া পুরনো বলেই মনে হত, একরাশ জঞ্জালের মতো। বোগেনভেলিয়া আর পলাশ গাছ থাকা সত্ত্বেও। সেজন্যেই হেমন্তবাবুদের বোধহয় ওরা উপেক্ষা করত।
একদিন মাঝরাত্তিরে লরির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ধ্রুবর। জিনিসপত্র যেন নামানো বা ওঠানো হচ্ছে। কুলিদের কথাবার্তা।
ধ্রুব বিছানা ছেড়ে বারান্দায় বেরিয়ে আসছিল। এত রাত্রে কিসের শব্দ জানার আগ্রহে। ও ভেবেছিল, রাখালবাবুর ড্রাম এসেছে। না, তা নয়। এসে দেখল, আসবাবপত্র ওঠানো হচ্ছে লরিতে।
ভেবেছিল, সামনের বাড়ির নীচতলার ভাড়াটেরা কেউ উঠে যাচ্ছে। কিন্তু না, নীচতলার ভাড়াটেরাও কেউ জানতে পারেনি। বোধহয় ঘুম ভাঙেনি তাদের। শুধু ধ্রুবরা লক্ষ করল, পরপর কদিনই দোতলার কোনও ঘরেই আলো জ্বলল না। শেষে একদিন জানা গেল হেমন্তবাবু বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছেন। বাড়ি বিক্রি করার লজ্জায় রাত্রে অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে চলে গেছেন তিনি।
ধ্রুবর বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মানুষটির জন্যে। বেচারা বোধহয় ভাল দামও পায়নি। গোপনে গোপনে তো বিক্রি করেছেন।
কে যে বাড়িটা কিনল তা ধ্রুবরা জানত না। অনেকদিন পড়ে ছিল, কোনও নতুন মালিক এসে দোতলায় দরজা জানালা খোলেনি।
এখন আর ধ্রুবর স্পষ্ট মনেও পড়ে না, নীচের ভাড়াটে রাখালবাবুরা কবে উঠে গেলেন। অন্য ভাড়াটেরাও।
শুধু মনে আছে, একদিন কয়েকজন লোক এসে কি সব মাপজোক করল, আর পরের দিন থেকে বাড়িটা ভাঙতে শুরু করল।
ওঃ, সে যে কি বিড়ম্বনা। মাসখানেক ধরে চলল বাড়ি ভাঙার কাজ। ধ্রুবদের বাড়ি তখন ধুলোয় ধুলো, যতবার বোয়া মোছা হয়, দেখতে দেখতে ঘরগুলো আবার ধুলোয় ভরে ওঠে। কি বিরক্তিকর দিনই না গেছে।
নতুন বাড়ি উঠতে শুরু হল সেই জমিতে। একটা সাইনবোর্ডও ছিল তখন। শোনা গেল ওই জমিতে চারতলা বাড়ি উঠবে, আটখানা ফ্ল্যাট হবে। ফ্ল্যাট বিক্রি হবে।
প্রীতির তখন থেকেই খুব বাড়ি বাড়ি নেশা। ও বলেছিল, খোঁজখবর নাও না, একটা
ফ্ল্যাট কিনে রাখলে ভাল হত।
ফ্ল্যাট কেনার কথা ধ্রুব তখন কল্পনার মধ্যেই আনতে পারে না। টাকা কোথায়। তাছাড়া নিজেকে ও তখনও সংসার থেকে পৃথক করে ভাবতে শেখেনি।
তাই প্রীতির কাছে শোনা কথাটা গিয়ে বলেছিল বড়বৌদির কাছে। বলেছিল, বাবাকে একবার বলে দেখ।
বড়বৌদিরও বোধহয় কথাটা মনে ধরেছিল। ধ্রুব বড়বৌদিকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল বাবার কাছে। একটা ফ্ল্যাট কিনে রাখলে হত। একেবারে পাড়ায়, বাড়ির সামনেই।
ধ্রুবর বাবা হাসলেন।এই বিরাট পরিবার, ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট কিনে কি হবে? তার চেয়ে কোথাও জমিটমি পাওয়া গেল বাড়ি করা যেত।
ব্যাস। ওখানেই সব স্বপ্ন থেমে গিয়েছিল। ওরা তখন সকলেই ব্যস্ত চাকরি নিয়ে। জমিটমি কে খুঁজবে। তাছাড়া বাবার কাছেও তেমন উৎসাহ পায়নি ধ্রুব। ইতিমধ্যে টিপু এসেছে। টিপু বড় হচ্ছে।
টিপু যতই বড় হচ্ছিল, ততই ঘরের অভাব দেখা দিচ্ছিল। ওদিকে একে একে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আসবাব বাড়ছিল ঘরের। পরিবারের লোকজন যতই বাড়ছে, বাড়িটা দিনেদিনে ততই যেন ছোট হয়ে যাচ্ছে। দাদার দুদুটি ছেলে। স্কুলে পড়ে। মেজদার একটি মেয়ে, সেও স্কুলে। সবশেষে এই টিপু, এও বড় হবে। বড়বৌদির সবসময়ে অভিযোগ, ছেলেদের পড়ার জায়গা নেই। মেজবৌদির অভিযোগ মেয়ের শোবার জায়গা নেই। এর ওপর সুমিতার আরো নানান বায়না। আত্মীয়স্বজনের আসা-যাওয়ারও বিরাম নেই। মেয়ে-জামাইও আসে মাঝে মাঝে।
একটা অশান্তি যেন দানা বাঁধছিল দিনে দিনে। আর চোখের সামনে ফ্ল্যাট বাড়িটা উঠছে। সেই পলাশ গাছটাও নেই, বোগেনভেলিয়াও সারা পাড়াটা এখন আর আলো কয়ে রাখে না। ওদিকে তাকালে মাঝেমাঝে হেমন্তবাবুর কথা মনে পড়ে। পুরনো হতশ্রী বাড়িটাকে শেষ পর্যন্ত আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। পারলেন না। শেষে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে পালাতে হল।