- বইয়ের নামঃ বাড়ি বদলে যায়
- লেখকের নামঃ রমাপদ চৌধুরী
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১.. ধ্রুবর বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল
ধ্রুবর বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। অথচ ওর সঙ্গে এ ব্যাপারটার কি সম্পর্ক। একজন অজ্ঞাতকুলশীল মানুষ। ভদ্রলোকের মুখ ও কোনওদিন দেখেছে কিনা জানে না। ভদ্রলোক যে এ পাড়ায় ছিলেন তাও জানত না, এবং জানার কোনওদিন প্রয়োজনও হয়নি। হয়তো এই মুহূর্তে ওঁকে দেখতে পেলে মনে পড়ত কোনওদিন আসা-যাওয়ার পথে দেখেছে কিনা। হতে পারে এই রাস্তায়, কিংবা দোকানে বাজারে ওঁকে প্রায়ই দেখতে পেত। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে সকলেই আছে, শুধু ভদ্রলোক নেই। থাকলেও বোধহয় চিনতে পারত না, কারণ ধ্রুব হাঁটাচলার পথে চোখ তুলে বড় একটা কারও মুখের দিকে তাকায় না। লোকজনকে এড়িয়ে চলাই ওর চরিত্র। পাড়ার কেউ ডেকে দুএকটা কথা বলতে চাইলেও হ্যাঁ না গোছের ক্ষুদ্র বাক্যে ভদ্রতা সারে, বড় জোর মুখে একটু স্মিত হাসি। ওটুকুও বানানো সৌজন্য। আসলে মানুষকে এড়িয়ে চলাই ওর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে, অথচ লোকে ভাবে এটা ওর অহঙ্কার। ধ্রুব নিজের মনেই হাসে, যখন আত্মীয়স্বজন কেউ এসে তেমন একটা অভিযোগ করে। কি নিয়ে অহঙ্কার করবে ও, কি আছে অহঙ্কৃত হবার মতো।
লোকটির কোনও পরিচয়ই যে জানত না, তাও স্বভাবের দোষে।
ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে খুব হনহন করে বাড়ি ফিরছিল, কিছুটা দেরি হয়ে গেছে বলে, কিছুটা চড়া রোদ্দুরের জন্যে। এই গলি দিয়ে এলে পথ অনেকখানি সংক্ষেপ করা যায়, তাই এদিক দিয়েই ওর যাতায়াত। বাস থেকে নেমে বকুলবাগানের বাড়িতে পৌঁছতে সময়ও লাগে, অনেকখানি হাঁটতেও হয়।
হনহন করে হেটেই আসছিল। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। নিছক কৌতূহল ছাড়া তখন আর কিছুই ছিল না। শুধু পথচারী দুএকজনের মুখের দিকে তাকাল, তাদের চোখেও কৌতূহল।
ডানদিক থেকে আরেকটা রাস্তা বেরিয়ে গেছে, সেটুকু পার হওয়ার সময়েই ওর হঠাৎ চোখে পড়ল। সামান্য কিছু লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তা দেখে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ার মানুষ ও নয়। কোলকাতার রাস্তাঘাটে জটলা তো লেগেই আছে, সেসব দেখে সারস পক্ষীটির মতো গলা বাড়িয়ে রহস্যের হদিস পাবার চেষ্টা করে না ধ্রুব। ও বরং এসব এড়িয়েই যায়। কিন্তু ওকেও থমকে দাঁড়াতে হল।
চুম্বকের মতো একটা আকর্ষণে ও এগিয়ে গেল। কারণ দৃশ্যটার দিকে চোখ পড়তেই ওর বুকের ভিতরটা ধক করে উঠেছে। আকস্মিক কোনও ভয় যেন মুহূর্তে ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
দ্রুত পায়ে ও সেদিকে এগিয়ে গেল।
এ রাস্তায় ফুটপাথ নেই বললেই চলে, তবে রাস্তাটা গলির মতো নিতান্ত সরু নয়। তারই অর্ধেক জুড়ে তুপীকৃত হয়ে পড়ে আছে একটি সংসারের যাবতীয় আসবাব। কেউ যেন ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যে ছুড়ে ছুড়ে বের করে দিয়েছে।
খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবল, বুক কেস। ত্রিভঙ্গ হয়ে পড়ে আছে নারকেল ছোবড়ার পুরু গদি। আর চারপাশ ঘিরে বালতি, মগ, হাঁড়িকুড়ি, রাশি রাশি মসলাপাতির কৌটো। একটা পুরোনো টিন টলে পড়েছে, তা থেকে গড়িয়ে পড়ছে সরষের তেল। একজন কে গিয়ে সেটা সোজা করে বসিয়ে দিল।
ধ্রুব ততক্ষণে ভিড়ের ফাঁকে উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওর বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল। নিজেরই মনে হল ওর মুখ কি এক অজানা আতঙ্কে বিবর্ণ হয়ে গেছে। সেই মুখ অন্যকে দেখাতেও যেন ভয়।
বিস্ময়ের চোখে ও তন্ন তন্ন করে জিনিসগুলোর ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে যাচ্ছিল। অস্ফুটে বলে উঠল, ইস্!
এক কোণে একটা খোলা উনোন, কেউ জ্বলন্ত উনোনে জল ঢেলে দিয়েছে। আর তারই আশেপাশে কড়াইয়ে আধ রান্না কিছু একটা তরিতরকারি, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িটা কাত হয়ে পড়ে আছে, তা থেকে ভাত গড়িয়ে পড়েছে ফুটপাথে।
একজন কে পিছন থেকে ধ্রুবকে জিগ্যেস করল, কি হয়েছে মশাই?
ধ্রুব কোনও উত্তর দিল না। প্রশ্নটা তো ওরও। পাশেই প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকানো ছেলেটি, বলে উঠল, শালা ছোটলোক, রান্না ভাতটুকুও খেতে দেয়নি।
আরেকজন ও প্রান্ত থেকে বললে, কি অবস্থা বেচারিদের।
তার গলার স্বরে বিষণ্ণতা মাখানো।
ততক্ষণে ধ্রুবর চোখ পড়ল বেশ কিছুটা দূরে একজন ভদ্রমহিলা, সঙ্গে দুটি বাচ্চা ছেলে, একটি ফ্রক পরা মেয়ে। ওরা সকলেই অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ভদ্রমহিলা মুখ নিচু করে আছেন, লজ্জায়। পাড়ার এত লোকের সামনে এমনভাবে অপদস্থ হওয়ার লজ্জা? কিংবা কে জানে, এখন তো ওঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে, হয়তো লজ্জা-অপমানের বোধটুকুও আর নেই।
ব্যাপারটা কি, বুঝতে অসুবিধে বার কথা নয়।
প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকানো ছেলেটি হঠাৎ বললে, ভদ্রলোক গেলেন কোথায়?
ওপাশের ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বৃদ্ধ লোকটি জবাব দিলেন, শুনছি তিনি তো সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে গেছেন। হয়তো কোর্টে।
হাতে স্ত্রী কে ঝোলানো কাঁচাপাকা চুলের লোকটি বললে, কোর্টে গিয়ে আর এখন কি হবে, হয়তো কোনও আস্তানার খোঁজে।
না, ধ্রুব একজনও চেনা লোক দেখতে পেল না। শেষে ওই ব্রীফ কেস হাতে লোকটিকেই জিগ্যেস করল, কি হয়েছে? জানেন কিছু?
লোকটি ভারী ব্রীফ কেস হাতে ঝুলিয়েও কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললে, দেখে বুঝতে পারছেন না? ইজেক্টমেন্ট। ভাড়াটে উচ্ছেদ।
বুঝতে যে পারছিল না, তা নয়। তবু কথাটা যেন শুনতে চাইছিল না। অন্য কিছু শুনতে পেলে খুশি হত। কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর কথাটাই শুনতে হল। ইজেক্টমেন্ট।