কফির পেয়ালা হাতে নেবার সঙ্গে সঙ্গে মিজানের টেলিফোন—
হ্যালো হুমায়ুন ভাই?
হ্যাঁ।
প্ল্যান-প্রোগ্রাম নিয়ে আপনার সঙ্গে আরেকবার বসা দরকার।
এখনো তো দেরি আছে।
দেরি আপনি কোথায় দেখলেন? এক সপ্তাহমাত্র। শালাদের একটা ভেলকি দেখিয়ে দেব। বাংলাদেশ বললে চিনতে পারে না, হা-করে তাকিয়ে থাকে। ইচ্ছা করে চড় মেরে মুখ বন্ধ করে দেই। এইবার শালারা বুঝবে বাংলাদেশ কি জিনিস। ঠিক না হুমায়ুন ভাই?
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।
শালাদের চোখ ট্যারা হয়ে যাবে দেখবেন। আমি আপনার এখানে চলে আসছি।
মিজান টেলিফোন নামিয়ে রাখলো। আমি আরেকটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। এই ছেলেটিকে আমি খুবই পছন্দ করি। তার সমস্যা একটাই, সারাক্ষণ মুখে বাংলাদেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন একটা খোলার চেষ্টা করেছিল। একজন ছাত্র থাকলে এসোসিয়েশন হয় না বলে সেই চেষ্টা সফল হয়নি। অন্য স্টেট থেকে বাংলাদেশী ছাত্র আনার চেষ্টাও করেছে, লাভ হয়নি। এই প্রচণ্ড শীতের দেশে কেউ আসতে চায় না। শীতের সময় এখানকার তাপমাত্রা শূন্যের ত্রিশ ডিগ্রি নিচে নেমে যায়, কে আসবে এই রকম ভয়াবহ ঠাণ্ডা একটা জায়গায়?
মিজান এই ব্যাপারে বেশ মনমরা হয়েছিল। বাংলাদেশ নাইট-এর ব্যাপারটা এসে পড়ায় সেই দুঃখ খানিকটা কমেছে। এই বাংলাদেশ নাইট নিয়েও বিরাট কাও। মোরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটির ফরেন স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজার মিজানকে বলল, তুমি এক কাজ কর–তুমি বাংলাদেশ নাইট পাকিস্তানীদের সঙ্গে কর।
মিজান হুংকার দিয়ে বলল, কেন?
এতে তোমার সুবিধা হবে। ডবল ডেকোরেশন হবে না। এক খরচায় হয়ে যাবে। তুমি একা মানুষ।
তোমার এত বড় সাহস, তুমি পাকিস্তানীদের সঙ্গে আমাকে বাংলাদেশ নাইট করতে বলছ? তুমি কি জান, ওরা কী করেছে? তুমি কি জান ওরা আমাদের কতজনকে মেরেছে? তুমি কি জান…?
কী মুশকিল–তুমি এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন?
তুমি আজেবাজে কথা বলবে, তুমি আমার দেশকে অপমান করবে, আর আমি তোমার সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলব?
মিজান, ফরেন স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজারের সামনের টেবিলে প্রকাণ্ড এক ঘুসি বসিয়ে দিল। টেবিলে রাখা কফির পেয়ালা উন্টে পড়ল। লোকজন ছুটে এল। প্রচণ্ড হৈচৈ।
এরকম মাথা গরম একটা ছেলেকে সব সময় সামলে-সুমলে রাখা মুশকিল। তবে ভরসা একটাই–সে আমাকে প্রায় দেবতার পর্যায়ে ফেলে রেখেছে। তার ধারণা আমার মতো জ্ঞানী-গুণী মানুষ শতাব্দীতে এক-আধটা জন্মায়। আমি যা বলি, শোনে।
মিজান তার ভাঙা মরিস মাইনর নিয়ে ঝড়ের গতিতে চলে এল। সঙ্গে বাংলাদেশের ম্যাপ নিয়ে এসেছে। সেই ম্যাপ দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম। যে কটা রঙ পাওয়া গেছে সব কটাই সে লাগিয়েছে।
জিনিসটা দাঁড়িয়েছে কেমন বলুন তো?
রঙ একটু বেশি হয়ে গেল না?
ওরা রঙ-চঙ একটু বেশি পছন্দ করে হুমায়ূন ভাই।
তাহলে ঠিকই আছে।
এখন আসুন প্রোগ্রামটা ঠিক করে ফেলা যাক। বাংলাদেশী খাবারের নমুনা হিসাবে খিচুড়ি খাওয়ানো হবে। খিচুড়ির শেষে দেওয়া হবে পান-সুপারি।
পান-সুপারি পাবে কোথায়?
শিকাগো থেকে আসবে। ইন্ডিয়ান শপ আছে–ওরা পাঠাবে। ডলার পাঠিয়ে চিঠি দিয়ে দিয়েছি।
খুব ভালো।
দেশ সম্পর্কে একটা বক্তৃতা দেয়া হবে। বক্তৃতার শেষে প্রশ্ন-উত্তর পর্ব।
সবার শেষে জাতীয় সঙ্গীত।
জাতীয় সঙ্গীত গাইবে কে?
কেন, আমি আর আপনি।
তুমি পাগল হয়েছ? জীবনে আমি কোনোদিন গান গাইনি।
আর আমি বুঝি হেমন্ত? এইসব চলবে না, হুমায়ুন ভাই। আসুন গানটা একবার প্রাকটিস করি।
মিজান, মরে গেলেও আমাকে দিয়ে গান গাওয়াতে পারবে না। তাছাড়া এই গানটার আমি কথা জানি না, সুর জানি না।
কথা সুর তো আমিও জানি না হুমায়ূন ভাই। চিন্তা নেই, একটা ব্যবস্থা হবেই।
উৎসবের দিন ভোর বেলাতে আমরা প্রকাণ্ড সসপ্যানে খিচুড়ি বসিয়ে দিলাম। চাল, ডাল, আনাজপাতি সেদ্ধ হচ্ছে। দুটো মুরগি কুচি কুচি করে ছেড়ে দেয়া হলো। এক পাউন্ডের মতো কিমা ছিল তাও ঢেলে দিলাম। যত ধরনের গরম মসলা ছিল সবই দিয়ে দিলাম। জ্বাল হতে থাকল।
মিজান বলল, খিচুড়ির আসল রহস্য হলো মিক্সিং-এ। আপনি ভয় করবেন। জিনিস ভালোই দাঁড়াবে।
সে একটা খুন্তি দিয়ে প্রবল বেগে নাড়াতে শুরু করল। ঘণ্টা দুয়েক পর যা দাঁড়াল তা দেখে বুকে কাঁপন লাগে। ঘন সিরাপের মতো একটা তরল পদার্থ। উপরে আবার দুধের সরের মতো সর পড়েছে। জিনিসটার রঙ দাঁড়িয়েছে ঘন কৃষ্ণ। মিজান শুকনো গলায় বলল, কালো হলো কেন বলুন তো হুমায়ূন ভাই। কালো রঙের কিছুই তো দেইনি।
আমি সেই প্রশ্নের জবাব দিতে পারলাম না। মিজান বলল, টমেটো পেস্ট দিয়ে দেব নাকি?
দাও।
টমেটো পেস্ট দেয়ায় রঙ আরো কালচে মেরে গেল। মিজান বলল, লাল রঙয়ের কিছু পুড কালার কিনে এনে ছেড়ে দেব?
দাও।
তাও দেয়া হলো। এতে কালো রঙের কোনো হেরফের হলো না। তবে মাঝে মাঝে লাল রঙ ঝিলিক দিতে লাগলো। দুজনেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। জাতীয় সংগীতেরও কোনো ব্যবস্থা হলো না। মিজানের গানের গলা আমার চেয়েও খারাপ। যখন গান ধরে মনে হয় গলায় সর্দি নিয়ে পাতিহাঁস ডাকছে। শিকাগো থেকে পানও এসে পৌঁছল না।
অনুষ্ঠান সন্ধ্যায়। বিকেলে এক অদ্ভুত ব্যাপার হলো। অবাক হয়ে দেখি দূর দূর থেকে গাড়ি নিয়ে বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা আসতে শুরু করেছে। শুনলাম মিজান নাকি অশপাশের যত ইউনিভার্সিটি আছে সব ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশ নাইটের খবর দিয়ে চিঠি দিয়েছিল। দেড় হাজার মাইল দূরে মন্টানো স্টেট ইউনিভার্সিটি, সেখান থেকে একটি মেয়ে গ্রে হাউন্ড বাসে করে একা একা চলে এসেছে। মিনেসোটা থেকে এসেছে দশজনের একটা বিরাট দল। তারা সঙ্গে নানান রকম পিঠা নিয়ে এসেছে। গ্রান্ড ফোকস থেকে এসেছেন করিম সাহেব, তাঁর ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রী! এই অসম্ভব কর্মঠ মহিলাটি এসেই আমাদের খিচুড়ি ফেলে দিয়ে নতুন খিচুড়ি বসালেন। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে সাউথ ডাকোটার ফলস স্প্রিং থেকে একদল ছেলেমেয়ে এসে উপস্থিত হল।