এক ঘন্টা সময়ে প্রতিটির উত্তর করতে হবে। আমি দেখলাম একটি প্রশ্নের অংশবিশেষের উত্তর আমি জানি, আর কিছুই জানি না। অংশবিশেষের উত্তর লেখার কোনো মানে হয় না। আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। এক ঘণ্টা পর সাদা খাতা জমা দিয়ে বের হয়ে এলাম।
পরদিনই রেজাল্ট হ’ল। এ-তো আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় যে পনেরোটি খাতা দেখতে পনেরো মাস লাগবে।
তিনজন এ পেয়েছে। দু’জন বি। বাকি সব সি। বাংলাদেশের হুমায়ুন আহমেদ পেয়েছে শূন্য। সবচে বেশি নম্বর পেয়েছে অন্ধ ছাত্রটি। [এ ছেলেটির নাম আমার মনে পড়ছে না। তার নামটা মনে রাখা উচিত ছিল।]
মার্ক গর্ডন আমাকে ডেকে পাঠালেন। বিস্মিত গলায় বললেন, ব্যাপারটা কী বলতো?
আমি বললাম, কোয়ান্টাম মেকানিক্সে আমার কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না। এই হায়ার লেভেলের কোর্স আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
বুঝতে পারছ না তাহলে ছেড়ে দিচ্ছ না কেন? ঝুলে থাকার মানে কী?
আমি ছাড়তে চাই না।
তুমি বোকামি করছ। তোমার গ্রেড যদি খারাপ হয়, যদি গড় গ্রেড সি চলে আসে তাহলে তোমাকে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যেতে হবে। গ্রাজুয়েট কোর্সের এই নিয়ম।
এই নিয়ম আমি জানি।
জেনেও তুমি এই কোর্সটা চালিয়ে যাবে?
হ্যাঁ।
তুমি খুবই নির্বোধের মতো কথা বলছ।
হয়ত বলছি। কিন্তু আমি কোর্সটা ছাড়ব না।
কারণটা বল।
একজন অন্ধ ছাত্র যদি এই কোর্সে সবচে বেশি নম্বর পেতে পারে আমি পারব কেন? আমার তো চোখ আছে।
তুমি আবারো নির্বোধের মতো কথা বলছ। সে অন্ধ হতে পারে কিন্তু তার এই বিষয়ে চমৎকার ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। সে আগের কোর্স সবগুলি করেছে। তুমি করনি। তুমি আমার উপদেশ শোন। এই কোর্স ছেড়ে দাও।
না।
আমি ছাড়লাম না। নিজে নিজে অংক শিখলাম। গ্রুপ থিওরি শিখলাম, অপারেটর এলজেব্রা শিখলাম। মানুষের অসাধ্য কিছু নেই এই প্রবাদটি সম্ভবত ভুল নয়। এক সময় অবাক হয়ে লক্ষ করলাম কোয়ান্টাম মেকানিক্স বুঝতে শুরু করেছি।
ফাইন্যাল পরীক্ষায় যখন বসলাম তখন আমি জানি আমাকে আটকানোর কোনো পথ নেই। পরীক্ষা হয়ে গেল। পরদিন মার্ক গড়ন একটি চিঠি লিখে আমার মেইল বক্সে রেখে দিলেন। টাইপ করা একটা সংক্ষিপ্ত চিঠি, যার বিষয়বস্তু হচ্ছে :
–তুমি যদি আমার সঙ্গে থিওরিটিক্যাল কেমিস্ট্রিতে কাজ কর তাহলে আমি আনন্দিত হব এবং তোমার জন্যে আমি একটি ফেলোশিপ ব্যবস্থা করে দেব। তোমাকে আর কষ্ট করে টিচিং অ্যাসিসটেন্টশিপ করতে হবে না।
একটি পরীক্ষা দিয়েই আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচিত হয়ে গেলাম। বিভাগীয় চেয়ারম্যান নিজের উদ্যোগে ব্যবস্থা করে দিলেন যেন আমি আমার স্ত্রীকে আমেরিকায় নিয়ে আসতে পারি।
পরীক্ষায় কত পেয়েছিলাম তা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। পাঠক পাঠিকারা আমার এই লোভ ক্ষমার চোখে দেখবেন বলে আশা করি। আমি পেয়েছিলাম ১০০ তে ১০০।
বর্তমানে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে কোয়ান্টাম কেজিস্ট্রি পড়াই। ক্লাসের শুরুতে ছাত্রদের এই গল্পটি বলি। শ্রদ্ধা নিবেদন করি ঐ অন্ধ ছাত্রটির প্রতি, যার কারণে আমার পক্ষে এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছিল। আরেকটি কথা, আমি কিন্তু মার্ক গর্ডনের সঙ্গে কাজ করতে রাজি হইনি। এই বিষয়টি নিয়ে আর কষ্ট করতে ইচ্ছা করছিল না, তাছাড়া আমার খানিকটা কুকুরভীতি আছে। মার্ক গর্ডনের লুকের মতো কুকুরটিকে পাশে নিয়ে কাজ করার প্রশ্নই উঠে না।
বাংলাদেশ নাইট
ভোর চারটার সময় টেলিফোন বেজে উঠল, অসময়ে টেলিফোন মানেই রিসিভার না নেয়া পর্যন্ত বুক ধড়ফড়। নির্ঘাৎ বাংলাদেশের কল। একগাদা টাকা খরচ করে কেউ যখন বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় কল করে তখন ঘটনা খারাপ ধরেই নিতে হবে। নিশ্চয়ই কেউ মারা-টারা গেছে।
তিনবার রিং হবার পর আমি রিসিভার তুলে ভয়ে ভয়ে বললাম, হ্যালো।
ওপার থেকে ভারী গলা শোনা গেল, হুমায়ূন ভাই, খিচুড়ি কি করে রান্না করতে হয় জানেন?
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। টেলিফোন করেছে মোরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটির মিজানুল হক। সেখানকার একমাত্র বাঙালি ছাত্র। অ্যাকাউন্টিং-এ আন্ডার গ্রাজুয়েট কোর্স করছে।
হ্যালো হুমায়ূন ভাই, কথা বলছেন না কেন? খিচুড়ি কী করে রান্না করতে হয় জানেন?
না।
তাহলে তো বিগ প্রবলেম হয়ে গেল।
আমি চুপ করে রইলাম। মিজানুল হক হড়বড় করে বলল, কাচ্চি বিরিয়ানির প্রিপারেশন জানা আছে?
আমি শীতল গলায় বললাম, কটা বাজে জান?
ক’টা?
রাত চারটা।
বলেন কি? এতরাত হয়ে গেছে? সর্বনাশ।
করছিলে কি তুমি?
বাংলাদেশের ম্যাপ বানাচ্ছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন হুমায়ুন ভাই। সকালে টেলিফোন করব, বিরাট সমস্যায় পড়েছি।
মিজানুল হক খট করে টেলিফোন রেখে দিল। আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। পার্কোলেটরে কফি বসিয়ে দিলাম। আমার ঘুমাবার চেষ্টা করা বৃথা। মিজানুল হকের মাথার ঠিক নেই, কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার টেলিফোন করবে। অন্য কোনও খাবারের রেসিপি জানতে চাইবে।
এ ব্যাপারটা গত তিন দিন ধরে চলছে। মোরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক বর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে অন্যান্য দেশের সঙ্গে উদ্যাপিত হবে বাংলাদেশ নাইট। এই অঞ্চলে বাংলাদেশের একমাত্র ছাত্র হচ্ছে মিজান, আর আমি আছি নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। মিজানের একমাত্র পরামর্শদাতা। আশপাশে সাতশ মাইলের মধ্যে দ্বিতীয় বাঙালি নেই।