আমাদের কোর্স কো-অর্ডিনেটর আমাকে বললেন, ফাইভ হানড্রেড লেভেলের এই কোর্সটি যে তুমি নিচ্ছ, ভুল করছ না তো? পারবে?
আমি বললাম, ইয়েস।
তখনো ইয়েস এবং নো-র বাইরে তেমন কিছু বলা রপ্ত হয়নি। কোর্স কো অর্ডিনেটর বললেন, এই কোর্সে ঢুকবার আগে কিন্তু ফোর হানড্রেঙ লেভেলের কোর্স শেষ করনি। ভালো করে ভেবে দেখ, পারবে?
ইয়েস।
কোর্স কো-অর্ডিনেটরের মুখ দেখে মনে হলো তিনি আমার ইয়েস শুনেও বিশেষ ভরসা পাচ্ছেন না।
ক্লাস শুরু হলো। ছাত্র সংখ্যা পনেরো। বিদেশী বলতে আমি এবং ইন্ডিয়ান এক মেয়ে কান্তা। ছাত্রদের মধ্যে একজন অন্ধ ছাত্রকে দেখে চমকে উঠলাম। সে তার ব্রেইলি টাইপ রাইটার নিয়ে এসেছে। ক্লাসে ঢুকেই সে বিনীত ভঙ্গিতে বলল, আমি বক্তৃতা টাইপ করব! খটখট শব্দ হবে, এ জন্যে আমি ক্ষমা চাচ্ছি আমি হতভম্ব। অন্ধ ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এটা আমি জানি। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছু অন্ধ ছাত্র-ছাত্রী আছে, তবে তাদের বিষয় হচ্ছে সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা বা দর্শন। কিন্তু থিওরিটিক্যাল কেমিস্ট্রিও কেউ পড়তে আসে আমার জানা ছিল না।
আমাদের কোর্স টিচারের নাম, মার্ক গর্ডন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মস্তান লোক। থিওরিটিক্যাল কেমিস্ট্রির লোকজন তাঁর নাম শুনলে চোখ কপালে তুলে ফেলে। তার খ্যাতি প্রবাদের পর্যায়ে চলে গেছে।
লোকটি অসম্ভব রোগা এবং তালগাছের মতো লম্বা। মুখ ভর্তি প্রকাণ্ড গোঁফ। ইউনিভার্সিটিতে আসেন ভালুকের মতো বড় একটা কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি যখন ক্লাসে যান কুকুরটা তার চেয়ারে পা তুলে বসে থাকে।
মার্ক গর্ডন ক্লাসে ঢুকলেন একটা টি শার্ট গায়ে দিয়ে। সেই টি শার্টে যা লেখা, তার বঙ্গানুবাদ হলো, সুন্দরী মেয়েরা আমাকে ভালোবাসা দাও।
ক্লাসে ঢুকেই সবার নামধাম জিজ্ঞেস করলেন। সবাই বসে বসে উত্তর দিল। একমাত্র আমি দাঁড়িয়ে জবাব দিলাম। মার্ক গর্ডন বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি দাঁড়িয়ে কথা বলছ কেন? বসে কথা বলতে কি তোমার অসুবিধা হয়?
আমি জবাব দেবার আগেই কান্তা বলল, এটা হচ্ছে ভারতীয় ভদ্রতা।
মার্ক গর্ডন বলেন, হুমায়ুন তুমি কি ভারতীয়?
না। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি।
ও আচ্ছা, আচ্ছা। বাংলাদেশ। বস। এর পর থেকে বসে বসে কথা বলবে।
আমি বসলাম। মানুষটাকে ভালো লাগল এই কারণে যে সে শুদ্ধভাবে আমার নাম উচ্চারণ করেছে। অধিকাংশ আমেরিকান যা পারে না কিংবা শুদ্ধ উচ্চারণের চেষ্টা করে না। আমাকে যে সব নামে ডাকা হয় তার কয়েকটি হচ্ছে : মায়ান, হিউমেন, হেমনি।
মার্ক গর্ডন টেবিলে পা তুলে বসলেন এবং বললেন, ক্লাস শুরু করার আগে একটা জোক বলা যাক। আমি আবার ডার্টি জোক ছাড়া অন্য কিছু জানি না। যারা ডার্টি জোক শুনতে চাও না, তারা দয়া করে কান বন্ধ করে ফেল।
গল্পটি হচ্ছে এক ফরাসি তরুণীকে নিয়ে যার একটি স্তন বড় অন্যটি ছোট। বিয়ের রাতে তার স্বামী…
গল্পটি চমৎকার, তবে এ দেশে তা আমার পক্ষে লেখা সম্ভব না বলে শুধু শুরুটা বললাম। গল্প শেষ হবার পর হাসি থামতে পাঁচ মিনিটের মতো লাগল। শুধু কান্তা হাসল না, মুখ লাল করে বসে রইল। যেন পুরো রসিকতাটা তাকে নিয়েই করা হয়েছে।
মার্ক গর্ডন লেকচার শুরু করলেন। ক্লাসের উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেল। বক্তৃতার শেষে তিনি বললেন, সহজ ব্যাপারগুলি নিয়ে আজ কথা বললাম, প্রথম ক্লাস তো তাই।
আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। কিছু বুঝতে পারিনি। তিনি ব্যবহার করছেন গ্রুপ থিওরি, যে গ্রুপ থিওরির আমি কিছুই জানি না।
আমি আমার পাশে বসে থাকা আমেরিকান ছাত্রটিকে বললাম, তুমি কি কিছু বুঝতে পারলে?
সে বিস্মিত হয়ে বলল, কেন বুঝব না, এসব তো খুবই এলিমেন্টারি ব্যাপার। এক সপ্তাহ চলে গেল। ক্লাসে যাই, মার্ক গড়নের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকি। কিছু বুঝতে পারি নাই। নিজের মেধা এবং বুদ্ধির উপর যে আস্থা ছিল তা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর প্রচুর বই জোগাড় করললাম। রাত দিন পড়ি। কোনও লাভ হয় না। এই জিনিস বোঝার জন্য ক্যালকুলাসের যে জ্ঞান দরকার তা আমার নেই। আমার ইনসমনিয়ার মতো হয়ে গেল। ঘুমুতে পারি না। গ্রেভার ইনের লবিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকি। মনে মনে বলি-কী সর্বনাশ।
আমার পাশের ঘরের বৃদ্ধা আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, তোমার কি হয়েছে বলতো? তুমি কি অসুস্থ? স্ত্রীর চিঠি পাচ্ছ না?
দেখতে দেখতে ডিম-টার্ম পরীক্ষা এসে গেল। পরীক্ষার পর পর যে লজ্জার সম্মুখীন হতে হবে তা ভেবে হাত-পা পেটের ভেতর ঢুকে যাবার জোগাড় হ’ল। মার্ক গর্ডন যখন দেখবে বাংলাদেশের এই ছেলে পরীক্ষার খাতায় কিছুই লেখেনি তখন তিনি কি ভাববেন? ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানই বা কী ভাববেন?
এই চেয়ারম্যানকেই ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের রসায়ন বিভাগের সভাপতি প্রফেসর আলি নওয়াব আমার প্রসঙ্গে একটি চিঠিতে লিখেছেন–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ যে অল্প সংখ্যক অসাধারণ মেধাবী ছাত্র তৈরি করেছে, হুমায়ুন আহমেদ তাদের অন্যতম।
অসাধারণ মেধাবী ছাত্রটি যখন শূন্য পাবে তখন কী হবে? রাতে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।
মিড-টার্ম পরীক্ষায় বসলাম। সব মিলিয়ে দশটি প্রশ্ন।