পাশের ঘরেই হোটেলের বার। সেখানে উদ্দাম গান হচ্ছে। খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে নারী-পুরুষ জড়াজড়ি করে নাচছে। গানের কথাগুলো পরিষ্কার নয়। একটি চরণ বার বার ফিরে ফিরে আসছে–Whom do you want to love yea? Yea শব্দটির মানে কি কে জানে?
রাতে ঘুম এল না ভয়ে–ভুতের ভয়।
এই ভূতের ভয়ের মুল কারণ, আমার ঘরে রাখা হোটেল গ্রেভার ইন সম্পর্কে একটি তথ্য-পুস্তিকা। সেখানে আছে, এই পাথরের হোটেলটি কে প্রথম বানিয়েছিলেন সেই সম্পর্কে তথ্য। বিখ্যাত ব্যক্তি কারা-কারা এই হোটেলে ছিলেন তাঁদের নাম-ধাম। সেই সব বিখ্যাত ব্যক্তির কাউকেই চিনতে পারলাম না, তবে এই হোটেলে একটি ভৌতিক কক্ষ আছে জেনে আঁতকে উঠলাম। রুম নম্বর ৩০৯-এ একজন অশরীরী মানুষ থাকেন বলে একশ বছরের জনশ্রুতি আছে। যিনি এখানে বাস করেন তার নাম জন পাউল। পেশায় আইনজীবী ছিলেন। এই হোটেলেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর হোটেলের মায়া কাটাতে পারেননি। পুস্তিকায় লেখা এই বিদেহী আত্মা অত্যন্ত শান্ত ও ভদ্র স্বভাবের। কাউকে কিছুই বলেন না। গভীর রাতে পাইপ হাতে হোটেলের বারান্দা দিয়ে হেঁটে বেড়ান।
হোটেলের তিনশ নয় নম্বর কক্ষটিতে কোনো অতিথি রাখা হয় না। বছরের পর বছর এটা খালি থাকে, তবে রোজ পরিস্কার করা হয়। বিছানার চাদর বদলে দেয়া হয়। বাথরুমে নতুন সাবান, টুথপেস্ট দেয়া হয়। ঘরের সামনে একটা সাইন বোর্ড আছে, সেখানে লেখা–’মি, জন পাউলের ঘর। নীরবতা পালন করুন। জন পাউল নীরবতা পছন্দ করেন।‘
পুরো ব্যাপারটা একধরনের রসিকতা কিংবা আমেরিকানদের ব্যবসা কৌশলের একটা অংশ, তবু রাত যতই বাড়তে লাগলো মনে হতে লাগলো এই বুঝি জন পাউল এসে আমার দরজায় দাঁড়িয়ে বলবেন–তোমার কাছে কি আগুন আছে? আমার পাইপের আগুন নিভে গেছে।
এমনিতেই ভয়ে কাঠ হয়ে আছি, তার উপর পাশের ঘরের বৃদ্ধা বিচিত্র সব শব্দ করছেন এই খকখক করে কাশছেন, এই চেয়ার ধরে টানাটানি করছেন, গানের সিকি অংশ শুনছেন, দরজা খুলে বেরুচ্ছেন আবার ঢুকছেন। শেষ রাতের দিকে মনে হলো দেশ-গাঁয়ের মেয়েদের মতো সুর করে বিলাপ শুরু করেছেন।
নিঃসঙ্গ মানুষদের অনেক ধরনের কষ্ট থাকে।
পুরোপুরি না ঘুমিয়ে কেউ রাত কাটাতে পারে না। শেষ রাতের দিকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ঘুম আসে। কিন্তু আমার এল না। পুরো রাত চেয়ারে বসে কাটিয়ে দিলাম। ভোরবেলা আমার ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল টেলিফোন করলো ওয়াশিংটন সিয়াটল থেকে। সে আমার আগে এদেশে এসেছে। পি-এইচ ডি করছে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে। পরিষ্কার লজিকের ঠাণ্ডা মাথায় একটা ছেলে। ভাবালুতা কিংবা অস্থিরতার কিছুই তার মধ্যে নেই। জটিল বিষয় নিয়ে গবেষণার ফাঁকে-ফাঁকে সে অসম্ভব সুন্দর কিছু লেখা লিখে ফেলেছে–কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ, দীপু নাম্বার টু, হাত কাটা রবীন। প্রসঙ্গের বাইরে চলে যাচ্ছি, তবু বলার লোভ সামলাতে পারছি না। জাফর ইকবালের লেখা পড়লে ঈর্ষার সূক্ষ্ম খোঁচা অনুভব করি। এই ক্ষমতাবান প্রবাসী লেখক দেশে তার যোগ্য সম্মান পেলেন না, এই দুঃখ আমার কোনোদিন যাবে না।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ইকবাল টেলিফোন করে খাস ময়মনসিংহের উচ্চারণে বললো–দাদাভাই কেমন আছো?
আমি বললাম, তুই আমার টেলিফোন নাম্বার কোথায় পেলি?
আমেরিকায় টেলিফোন নাম্বার পাওয়া কোনো সমস্যা না। তুমি কেমন আছো বল?
তোর কাছে ডলার আছে?
তোমাকে একশ ডলারের একটা ড্রাফট পাঠিয়ে দিয়েছি। আজই পাবে।
একশ ডলারে হবে না। তুই আমাকে একটা টিকিট কেটে দে আমি দেশে tলে যাবে।
আমার কথায় সে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। সহজ গলায় বললো, যেতে চাও কোনো অসুবিধা নেই টিকিট কেটে দেবো। কয়েকটা দিন যাক। একটু ঘুরে ফিরে দেখো। এখানে বাংলাদেশী ছেলে নেই?
বাংলাদেশেী ছেলে আমার কোনো দরকার নেই। তুই টিকিট কেটে পাঠা।
আচ্ছা পাঠাবে। তুমি কি পৌঁছার সংবাদ দেশে দিয়েছো? ভাবীকে চিঠি লিখেছো?
চিঠি লেখার দরকার কি আমি নিজেই তো যাচ্ছি।
তা ঠিক। তবু লিখে দাও। যেতে-যেতেও তো সময় লাগবে। আজই লিখে ফ্যালো। আর শোনো, তোমার যে খুব খারাপ লাগছে দেশে চলে যেতে চাচ্ছো এইসব না লিখলেই ভালো হয়।
আমি চুপ করে রইলাম। ইকবাল বললো, রাতে তোমাকে আবার টেলিফোন করবো। আর আমি তোমাদের ফরেন স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজারকেও ফোন করে বলে দিচ্ছি যাতে তিনি বাংলাদেশী ছেলেদের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ করিয়ে দেন।
সেই সময় ফার্গো শহরে আর একজন মাত্র বাঙালি ছিলেন–সুফী সাহেব। তিনি এসেছেন এগ্রোনমিতে পি-এইচ-ড়ি করতে। তার সঙ্গে আমার কোনো রকম যোগাযোগ হলো না। দিনের বেলাটা ইউনিভার্সিটিতে খানিকক্ষণ ঘুরলাম। চারদিকে বড় বেশি ঝকঝকে, তকতকে। বড় বেশি গোছানো। বিশ্ববিদ্যালয় সামারের বন্ধ থাকলেও কিছু কিছু ক্লাস হচ্ছে। একটা ক্লাস রুমে উঁকি দিয়ে দেখি অনেক ছেলেমেয়ের হাতে কফির কাপ কিংবা কোল্ড ড্রিংকের বোতল। আরাম করে খাওয়া-দাওয়া করতে করতে অধ্যাপকদের বক্তৃতা শুনছে। পৃথিবীতে দু’ধনের মানুষ আছে। এক ধরনের কাছে বিদেশের সব কিছুই ভালো লাগে, অন্যদের কিছুই ভালো লাগে না। আমি দ্বিতীয় দলের। আমার কাছে কিছুই ভালো লাগে না। যা দেখি তাতেই বিরক্ত হই।