নাম নিয়ে যে এরা যথেষ্ট ফাজলামি করে সে সম্পর্কে সন্দেহের কারণ নেই। এর পশুর নামে নাম রাখে যেমন, Mr. Fox, Mr. Lion, Mr. Lamb. এরা কীট-পতঙ্গের নামে নাম রাখে যেমন, Mr. beetle (গুবরে পোকা)। একটা নাম পেয়েছিলাম যার বাংলার মানে–ষাড়ের গোবর (Mr. bull durig Junior)। অবশ্যি বাংলা ভাষাতেও খাদা, গেদা, নাম রাখা হয়। তবে সেসব নাম নিয়ে আমরা বড়াই করি না। আমেরিকানরা করে। আমি একজন আন্ডার-গ্রাজুয়েট ছাত্র পেয়েছিলাম সে খুব বড়াই করে বললো–আমার নাম Back Bison (বাইসনের পাছা)।
ধরাকে সরা জ্ঞান করার একটা প্রবণতা আমেরিকানদের আছে। ঢাকা শহরে একবার এক আমেরিকানকে খালি গায়ে হাফ প্যান্ট পরা অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে যেতে দেখেছি। গাড়িতে একজন বাঙালি তরুণী এবং দুইজন বাঙালি যুবক। আমি জানি না, তবে আমার বিশ্বাস আমেরিকানটির খালি গায়ে গাড়ি চালানোর যুক্তি বোধহয় এদেশের গরম। আমাদের প্রাচ্যদেশীয় সভ্যতায় এই আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়, এটা তারা জেনেও এই কাজ করবে। ভাবটা এরকম, আমরা কোনো কিছুই পরোয়া করি না। এরা যখন আমাদের দেশে আসবে তখন আমাদের আচার আচরণকে সম্মান করবে এটা আমার বিশ্বাস আশা করবো। তারা যখন তা করবে না তখন মনে করিয়ে দেবো যে তারা যা করছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা প্রায় কখনোই তা করি না। সাদা চামড়া দেখলে এখনো আমাদের হুশ থাকে না। যাক পুরোনো প্রসঙ্গে ফিরে যাই।
আমি খুব যে একজন বিপ্লবী ধরনের ছেলে তা নয়। বড় বড় অন্যায় দেখি কিন্তু তেমন কোনো সাড়াশব্দ করি না। সব সময় মনে হয় প্রতিবাদ অন্যেরা করবে আমার ঝামেলায় যাবার দরকার নেই। তবু বিকৃত উচ্চারণে বিদেশীদের নাম বলাটা কেন জানি শুরু থেকেই সহ্য হলো না। একটা আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করলাম যাতে আমেরিকানরা শুদ্ধ নামে ঢাকার একটা চেষ্টা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের খবরের কাগজে চিঠি লিখলাম, আমার যুক্তি আমেরিকানরা ইচ্ছে করে বিদেশীদের ভুল উচ্চারণে ডাকে। উদাহরণ হচ্ছে, শীলা নামটা সঠিক উচ্চারণ না করতে পারার কোনোই কারণ নেই। এর কাছাকাছি নাম তাদের আছে। কিন্তু যেই তারা দেখবে এই নামটা একজন বিদেশীর, অমনি উচ্চারণ করবে–শেইল (Sheila), এর মানে কী?
সাত বছর ছিলাম আমেরিকায়। এই সাত বছরে অনেক চেষ্টা করলাম ওদের দিয়ে শুদ্ধভাবে আমার নামটা বলাতে পারলাম না। ফল এই হলো যে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রটে গেল ‘হামাম’ নামের এই ছেলের মাথায় খনিকটা গণ্ডগোল আছে। তবে ছেলে ভালো।
বিদেশের পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আসছি। আমার দেশে ফিরে যাওয়া উপলক্ষে প্রফেসর গ্লাস তার বাড়িতে একটা পার্টি দিলেন। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার, এই পার্টিতে প্রথমবারের মতো সে শুদ্ধ উচ্চারণ করলো। আমার দীর্ঘদিনের আন্দোলনের সুন্দর পরিণতি। আমার ভালো লাগার কথা। আনন্দিত হবার কথা। কেন জানি ভালো লাগলো না।
গ্লাস গাড়িতে করে আমাকে পৌঁছে দিচ্ছে।
আমি বললাম, এই তো সুন্দর করে তুমি আমার নাম বলতে পারছো। আগে কেন বলতে পারতে না?
গ্লাস খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বললো, বিদেশীদের আমরা একটু আলাদা করে দেখি। আমরা তাদের রহস্যময়তা ভাঙতে চাই না। তাদের অন্য রকম করে ডাকি। অন্য কিছু না।
অধ্যাপক গ্লাসের কথা কতটুকু সত্যি আমি জানি না। সে যেভাবে ব্যাপারটাকে দেখেছে অন্যরাও সেভাবে দেখেছে কিনা তাও জানি না। গ্লাসের কথা আমার ভালোই লাগলো। আমি হাসিমুখে বললাম, তুমি আমাকে তোমার মতো করেই ডাকো।
বিদায় নিয়ে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে গ্লাস বললো, হামান, ভালো থেকো এবং আগলি আমেরিকানদের কথা মনে রেখো।